আল কুরআন বিষয়ক বই ডাউনলোড করতে নিচে বইয়ের নামের উপর ক্লিক করুন।
১। অযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করলে গুনাহ হবে কি – মোঃ মতিয়ার রহমান
২। অলৌকিক কিতাব আল কুরআন – আহমেদ দিদাত
৩। আয়াতুল কুরসি ও তাওহীদের প্রমাণ – আব্দুর রাযযক ইবন আব্দুল মুহসিন
৪। আয়াতুল কুরসির তাৎপর্য – খন্দকার আবুল খায়ের
৫। আল কুরআন এক নজরে একশত চৌদ্দ সূরা – অধ্যাপক মুজিবুর রহমান
৬। আল কুরআন ও তার সুমহান মর্যাদা – আব্দুল আযীয ইবন আব্দুল্লাহ
৭। আল কুরআন জিজ্ঞাসা ও জবাব – ড. আবদুল ওয়াহিদ
৮। আল কুরআন তিলাওয়াতের নিয়ম কানুন – মুহাম্মদ নাসীল শাহরুখ
৯। আল কুরআন বুঝে পড়া উচিত – ড. জাকির নায়েক
১০। আল কুরআন মহাসংবিধান – দিদারুল ইসলাম
১১। আল কুরআন শিক্ষা পদ্ধতি – মুফতি সুলতানা মাহমুদ
১২। আল কুরআন সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ – ওবায়দুল হক
১৩। আল কুরআন সংলাপ – অধ্যাপক মুজিবুর রহমান
১৪। আল কুরআনে উদাহরণ – অধ্যাপক মুজিবুর রহমান
১৫। আল কুরআনে এবং সৃষ্টির নিদর্শনে আল্লাহ তাআলার পরিচয় – ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান
১৬। আল কুরআনে রহিত (মানসুখ) আয়াত আছে প্রচলিত এ কথাটি কি সঠিক – মোঃ মতিয়ার রহমান
১৭। আল কুরআনের ১৬০ মুজিজা ও রহস্য – ড. মাজহার কাজী
১৮। আল কুরআনের আলোকে আরবী শিক্ষা – আবু তাহের
১৯। আল কুরআনের সার সংক্ষেপ – মাওলানা মুহাম্মদ তৈয়ব আলী
২০। আল কুরআনের গঠন পদ্ধতি – মোঃ মতিয়ার রহমান
২১। আল কুরআনের গল্প – এস.এম রুহুল আমিন
২২। আল কুরআনের দৃষ্টিতে ইবাদাতের সঠিক অর্থ – দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী
২৩। আল কুরআনের পরিচয় – মতিউর রহমান নিজামী
২৪। আল কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী ও প্রতিশ্রুতির বিস্ময়কর বাস্তবায়ন – আজিজুল হক ভুঁইয়
২৫। আল কুরআনের ভাষা – এস এম নাহিদ হাসান
২৬। আল কুরআনের মানদন্ডে সফলতা ও ব্যর্থতা – দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী
২৭। আল কুরআনের শিক্ষা – মুহাম্মদ ইকবাল কিলানী
২৮। আল কুরআনের শিক্ষা – ইউসুফ ইসলাহী
২৯। আল কুরআনের শিল্পিক সৌন্দর্য – সাইয়েদ কুতুব শহীদ
৩০। আল কুরআনের সংলাপ – অধ্যাপক মফিজুর রহমান
৩১। আল কুরানের আলোকে উন্নত জীবনের আদর্শ – মুহাম্মদ আবদুর রহীম
৩২। আল কুরআনের আলোকে মানুষ ও মানুষের শেষ পরিণতি – মোঃ সিরাজুল ইসলাম
৩৩। আল ফাতিহা – আবুল হাশিম
৩৪। ইচ্ছাকৃতভাবে অর্থ না বুঝে কুরআন পড়া সওয়াব না গুনাহ – মোঃ মতিয়ার রহমান
৩৫। ইহিতাসাবত সম্পর্কে কোরানে অবতীর্ণ আয়াত সমূহ – নুমান আবুল বাশার
৩৬। কুরআন অধ্যয়ন সহায়িকা – খুররম জাহ মুরাদ
৩৭। কুরআন আপনার পক্ষে কিংবা বিপক্ষের দলিল – মুহাম্মদ ইবন আহমদ
৩৮। কুরআন ইতিহাস হাদিস – সৈয়দ ওয়ালিউল আলম
৩৯। কুরআন ও সুন্নাহঃ স্থান কাল পাত্র – তাহা জাবির আল আলওয়ানী
৪০। কুরআন ও হাদীস সংকলন ১ম খণ্ড – মোঃ রফিকুল ইসলাম
৪১। কুরআন ও হাদীস সঞ্চয়ন ১ম, ২য় ও ৩য় – আতিকুর রহমান ভূঁইয়া
৪২। কুরআন গবেষণার মূলনীতি – আমিন আহসান
৪৩। কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত – মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল-উসাইমীন
৪৪। কুরআন দিয়ে নিজের চিকিৎসা করুন – আবুল ফিদা মুহাম্মাদ ইজ্জত মুহাম্মাদ আরেফ
৪৫। কুরআন পড়ি কুরআন বুঝি আল কুরআনের সমাজ গড়ি – মুহাম্মদ ইকবাল কিলানী
৪৬। কুরআন পড়ো জীবন গড়ো – আবদুস শহীদ নাসিম
৪৭। কুরআন প্রেমিক দেশবাসীর প্রতি আমার খোলা চিঠি – দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী
৪৮। কুরআন বুঝা সহজ – অধ্যাপক গোলাম আযম
৪৯। কুরআন বোঝার পথ ও পাথেয় – আবদুস শহীদ নাসিম
৫০। কুরআন ব্যাখ্যার মুলনীতি – শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী
৫১। কুরআন মজীদের দোয়া ও মোনাজাত ইতিহাস দর্শন ফজিলত – মোঃ শহীদুল্লাহ যুবাইর
৫২। কুরআন মাজীদের কিছু গোপণ রহস্য – হারুন ইয়াহইয়া
৫৩। কুরআন শরীফ তিলাওয়াত, এর মর্যাদা, মাহাত্ম ও ফযিলত
৫৪। কুরআন শিক্ষাঃ বিধান পদ্ধতি ও ফযিলত – হাবীবুল্লাহ মুহাম্মদ ইকবাল
৫৫। কুরআন শিক্ষার সহজ পদ্ধতি – আবু আহমাদ সাইফুদ্দীন বেলাল
৫৬। কুরআন সম্পর্কে কুরআন কি বলে – আব্দুর রহমান
৫৭। কুরআন হাদিস সংকলনের ইতিহাস – এ কে এম এনামুল হক
৫৮। কুরআন হাদীসের আলোকে শহীদ কারা – আবদুল মতিন বিক্রমপুরী
৫৯। কুরআন হাদীসের পঁইত্রিশটি ভবিষ্যদ্বাণী – খন্দকার শাহরিয়ার সুলতান
৬০। কুরআনে বর্ণিত লোকমান এর উপদেশ হে আমার সন্তান – মোঃ আব্দুল আলীম
৬১। কুরআনের অভিধান – মুনির উদ্দিন আহমদ
৬২। কুরআনের অর্থ বুঝার সহজ অভিধান – আব্দুল হালিম
৬৩। কুরআনের অলৌকিকত্ব – হারুন ইয়াহিয়া
৬৪। কুরআনের আয়না THE MIRROR OF THE HOLLY QURAN – আবুল হাছানাত কাজী মোঃ কিয়াম উদ
৬৫। কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা – সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী
৬৬। কুরআনের চিরন্তন মু জিযা – ডঃ মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান
৬৭। কুরআনের জ্ঞান বিতরণে তাফহিমুল কুরআনের ভূমিকা – আবদুস শহীদ নাসিম
৬৮। কুরআনের তাফসীর করা বা তাফসীর পড়ে সঠিক জ্ঞানের অর্জনের মূলনীতি – মোঃ মতিয়ার রহমান
৬৯। কুরআনের দেশে মাওলান মওদুদী – মুহাম্মদ আসেম
৭০। কুরআনের পরিভাষা – ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান
৭১। কুরআনের বাণী ও আমাদের করণীয় – মোঃ মোরতুজা আলী
৭২। কুরআনের মর্মকথা – সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী
৭৩। কুরআনের মহত্ত্ব ও মর্যাদা – সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী
৭৪। কুরআনের মু জিযাহ – নুর হোসেন মজিদী
৭৫। কুরআনের সংক্ষিপ্ত আলোচনা – সাইয়েদ কুতুব শহীদ
৭৬। কুরআনের সঙ্গে পূর্বসূরিদের সম্পর্ক – খালেদ বিন আব্দুল্লাহ আল মুসলিম
৭৭। কুরাআনের চিরন্তন মুযেজা – ড. মুহাম্মাদ মুজিবর রহমান
৭৮। জানার জন্য কুরআন মানার জন্য কুরআন – আবদুস শহীদ নাসিম
৭৯। তাজবিদ শিক্ষা – মুহাম্মদ সফিকুল্লাহ
৮০। তাফসীর কি মিথ্যা হতে পারে – আব্দুর রাযযক বিন ইউসুফ
৮১। তাফসীরে সুরা তওবা ২য় খণ্ড – ডঃ আব্দুল্লাহ আযযাম
৮২। নূরানী পদ্ধতিতে ২৭ ঘণ্টায় কুরআন শিক্ষা – প্রকৌশলী মইনুল হোসেন
৮৩। পবিত্র কুরআন প্রচারের ইতিহাস ও বঙ্গানুবাদের ইতিহাস – মোফাখখার হুসেইন খান
৮৪। পবিত্র কুরআন শিক্ষা পদ্ধতি – মুফতি সুলতান মাহমুদ
৮৫। পবিত্র কুরআনে জেরুজালেম – ইমরান নজর হোসেন
৮৬। পবিত্র কোরআনের মু’জিজা – দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী
৮৭। প্রচলিত বিভিন্ন খতম তাৎপর্য ও পর্যালোচনা – মুস্তাফা সোহেল হিলাল
কোরআনের পরিচিতিঃ কোরআন আল্লাহর নাযিলকৃত ঐ কিতাবকে বলা হয়, যা তিনি তার শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপরে দীর্ঘ তেইশ বৎসর কালব্যাপী বিভিন্ন পর্যায়ে, প্রয়োজন মোতাবেক অল্প অল্প করে অবতীর্ন করেছিলেন। ভাষা এবং ভাব উভয় দিক হতেই কোরআন আল্লাহর কিতাব। অর্থাৎ কোরআনের ভাব (অর্থ) যেমন আল্লাহর তরফ হতে আগত তেমনি তার ভাষাও।
কোরআন নাযিলের কারণঃ নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষনের পরে আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ)-কে বেহেশ্ত হতে দুনিয়ায় পাঠানোর প্রাক্কালে আল্লাহ্ তায়ালা বলে দিয়েছিলেন যে, “তোমরা সকলেই এখান হতে নেমে পড়। অতঃপর তোমাদের কাছে আমার পক্ষ হতে জীবন বিধান যেতে থাকবে পরন্তু যারা আমার জীবন বিধান অনুসারে চলবে, তাদের ভয় ও চিন্তার কোন কারণ থাকবে না। (অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তিতে তারা আবার অনন্ত সুখের আধার এই বেহেশতেই ফিরে আসবে)। আর যারা উহাকে অস্বীকার করে আমার নিদর্শন সমূহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে”। (সূরা বাকারা আয়াত নং ৩৮,৩৯)
আল্লাহ তায়ালার উক্ত ঘোষণা মোতাবেকই যুগে যুগে আদম সন্ততির কাছে আল্লাহর তরফ হতে হেদায়েত বা জীবন বিধান এসেছে। এই জীবন বিধানেরই অন্য নাম কিতাবুল্লাহ। যখনই কোন মানব গোষ্ঠী আল্লাহর পথকে বাদ দিয়ে নিজেদের মন গড়া ভ্রান্ত পথে চলতে থাকে, তখনই কিতাব নাযিল করে আল্লাহ মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে থাকেন।
কিতাব নাযেলের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার চিরন্তন নীতি হল এই যে, তিনি যখন কোন জাতির জন্য কিতাব নাযিলের প্রয়োজনীয় অনুভব করেন, তখনই সেই জাতির মধ্য হতে মানবীয় গুণের অধিকারী সর্বোৎকৃষ্ঠ লোকটিকে পয়গাম্বর হিসেবে বাছাই করে নেন, অতঃপর ওয়াহীর মাধ্যেমে তার উপরে কিতাব নাযিল করে থাকেন।
মানব সৃষ্টির সূচনা হতে দুনিয়ায় যেমন অসংখ্য নবী-রসূল এসেছেন, তেমনি তাঁদের উপরে নাযিলকৃত কিতাবের সংখ্যাও অগণিত। নবীদের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) যেমন সর্বশেষ কিতাব। অতঃপর দুনিয়ায় আর কোন নতুন নবীও আসবে না এবং কোনও নতুন কিতাবও অবতীর্ণ হবে না।
কোরআনের আলোচ্য বিষয় ও উদ্দেশ্যঃ কোরআনের আলোচ্য বিষয় হল, মানব জাতি। কেননা মানব জাতির প্রকৃত কল্যাণ ও অকল্যাণের সঠিক পরিচয়ই কোরআনে দান করা হয়েছে। কোরআনের উদ্দেশ্য হল মানব জাতিবে খোদা প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থার দিকে পথ প্রদর্শন, যাতে সে দুনিয়ায়ও নিজের জীবনকে কল্যাণময় করতে পারে এবং পরকালেও শান্তিময় জীবনের অধিকারী হতে পারে।
ওয়াহীর সূচনা কিভাবে হয়েছিলঃ বোখারী শরীফ হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। তাতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, ওয়াহীর সূচনা এভাবে হয়েছিল যে, হুজুর ঘুমের ঘোরে এমন বাস্তব স্বপ্ন দেখতে থাকেন যা উজ্জ্বল প্রভাতের ন্যায় বাস্তবায়িত হতে থাকে। অতঃপর হুজুরের নিকটে নির্জনবাস আকর্ষণীয় অনুভূত হল এবং তিনি হেরা গুহায় নির্জনবাস শুরু করে দিলেন। এখানে তিনি একাধিক রাত্রি একত্রে কাটিয়ে দিতেন এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য পানীয় ও জরুরী সামগ্রী সাথে নিয়ে যেতেন। উহা ফুরিয়ে গেলে আবার ফিরে এসে হযরত খাদীজার নিকট হতে উহা নিয়ে গুহায় ফিরে যেতেন। এভাবেই এক শুভক্ষণে হেরায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তাঁর কাছে হকের (ওয়াহীর) আগমন ঘটল। ফিরিশতা (জিবরাঈল আমিন) এসে তাঁকে বললেন, আপনি পড়ুন। (হুজুর বলেন) আমি বললাম, আমি পাঠক নই। হুজুর বলেন, অতঃপর ফিরিশতা আমাকে বগলে দাবিয়ে ছেড়ে দিলেন। ফলে আমি খুব ক্লান্তি বোধ করতে থাকলাম। আবার তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দিলেন। এভাবে তিনি তিনবার করলেন এবং তিনবারই হুযুর একই জওয়াব দিলেন। অতঃপর ফিরিশতা পাঠ করলেনঃ
“তুমি পাঠ কর তোমার সেই প্রভূর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানব জাতিকে ঘণীভূত রক্ত বিন্দু হতে। তুমি পাঠ কর তোমার সেই মহিমান্বিত প্রভূর নামে যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। যিনি মানব জাতিকে শিখিয়ে দিয়েছেন যা সে জানত না”। (সূরা আলাক আয়াত নং ১-৫)
অতঃপর হুজুর উক্ত আয়াতসমূহ নিয়ে কম্পিত হৃদয়ে বাড়ি ফিরলেন। আর খাদীজার (রাঃ) ঘরে প্রবেশ করে বললেন, আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও। এভাবে কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়ার কিছুক্ষণ পরে তাঁর অস্থিরতা কেটে গেল। তিনি হযরত খাদীজাকে আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা শুনালেন এবং বললেন, আমার নিজের জীবন সম্পর্কেই আমার ভয় হচ্ছে। হযরত খাদীজা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আল্লাহর শপথ, আল্লাহ কিছুতেই আপনার কোন অনিষ্ট করবেন না। কেননা আপনি আত্মিয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, দরিদ্র ও নিরন্নকে সাহায্য করেন, অতিথীদের সেবা করেন এবং উত্তম কাজের সাহায্য করেন। অতঃপর হযরত খাদীজা হুজুরকে নিয়ে তাঁর চাচাত ভাই অরাকা বিন নওফলের কাছে গেলেন। তিনি জাহেলিয়াতে ইসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং ইবরাণী ভাষা জানতেন। আর ইনজিল হতে উক্ত ভাষায় যা ইচ্ছা নকল করতে পারতেন। তিনি খুবই বৃদ্ধ ছিলেন এবং দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। খাদীজা তাকে সম্বোধন করে বললেন, ভাই আপনি আপনার ভাইপোর ঘটনা শুনুন, তিনি বললেন, এতো সেই ফিরিশতা যিনি হযরত মুসার (আঃ) কাছে এসেছিলেন। আফসোস! তোমার লোকেরা তোমাকে যখন দেশ হতে বের করে দিবে, তখন যদি আমি জীবিত থাকতাম! হুজুর বললেন, তাহলে কি তারা আমাকে বের করে দিবে? অরাকা বললেন, হ্যাঁ, তুমি যা পেয়েছ ইহা যে যে পেয়েছে তার সাথে অনুরূপ ব্যবহার করা হয়েছে। আমি যদি ঐ দিন জীবিত থাকি, তাহলে তোমাকে সাধ্যমত সাহায্য করব। অতঃপর পুনরায় ওয়াহী নাযিলের আগেই অরাকা ইনতেকাল করেন।
উপরোক্ত ঘটনাটি যেদিন ঘটে সেদিন ছিল ১৭ই রমজান সোমবার। হুজুরের বয়স ছিল তখন চল্লিশ বছর ছয় মাস আট দিন। অর্থাৎ ৬ই আগস্ট ৬১০ খৃস্টাব্দ।
ওয়াহী কিভাবে নাযিল হতঃ হুযুরের উপরে যখন ওয়াহী অবতীর্ণ হতো তখন হুজুরের ভিতরে এক বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হত। চেহারা মোবারক উজ্জ্বল ও রক্তবর্ণ হয়ে যেত, কপালে ঘাম দেখা দিত, নিঃশ্বাস ঘন হত এবং শরীর অত্যধিক ভারী হয়ে যেত। এমন কি উটের পিঠে ছওয়ার অবস্থায় যখন ওয়াহী নাযিল হত, তখন অত্যধিক ভারে উট চলতে অপারগ হয়ে মাটিতে বসে যেত।
ওয়াহী নাযিলের সময় কেন এমন অবস্থা হত, এর কারণ স্বরূপ বলা চলে যে, নবীগণ ছোট বড় সব রকমের গোনাহ্ হতে পবিত্র থাকার ফলে তাদের স্বভাবের অধিক্য থাকলেও তারা মানবীয় স্বভাবের উর্ধে নন। ফলে আল্লাহ তাঁর পবিত্র কালাম নাযিল করার পূর্ব মুহূর্তে তাদেরকে এমন এক বিশেষ নুরানী অবস্থায় নিয়ে যেতেন, যেখানে তাদের কলব মানবীয় সবটুকু বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফিরিশতা স্বভাবে রূপান্তরিত হত এবং আল্লাহর অনুগ্রহের নূর তাদের অন্তর-আত্মাকে মোহিত করে ফেলত। ফলে এক নীরব ও মহাপ্রশান্তিময় পরিবেশে আল্লাহ তার কালাম নবীদের পরে নাযিল করতেন। কেননা আল্লাহর পবিত্র কালাম পূর্ণ মনোনিবেশ সহকারে শুনা, উহা অন্তরে গেঁথে রাখা এবং ইহার প্রকৃত মর্ম হৃদয় মন দিয়ে অনুধাবন করার জন্য উপরোক্ত বিশেষ অবস্থায় নবীদেরকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হত।
এভাবে যখন ওয়াহী নাযিল হওয়া সমাপ্ত হত, তখন উপরোক্ত অবস্থা কেটে যেত এবং হুজুর পুর্বাবস্থায় ফিরে আসতেন। আর নাযিলকৃত কালাম ছাহাবাদেরকে তেলাওয়াত করে শুনাতেন।
ওয়াহী কিভাবে নাযিল হত সে সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে নিম্নলিখিত মর্মে একটি হাদীস বর্নিত আছেঃ
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা হারিস-বিন হিসাম হুজুরকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসুল, আপনার উপরে ওয়াহী কিরূপে নাযিল হয়? হুজুর বললেন, কখনও কখনও ওয়াহীর আওয়াজ (আমার অন্তরে) ঘন্টা ধ্বনির ন্যায় ধ্বনিত হতে থাকে। ওয়াহীর এই ধরনটাই আমার জন্য খুব কঠিন হয় এবং আমি ক্লান্তি বোধ করতে থাকি। অতঃপর উহা আমার অন্তরে বিঁধে যায়। আবার কখনও ফিরিশতা মানুষের আকৃতিতে আসেন এবং আমার সাথে কালাম করেন (ওয়াহী নাযিল করেন)। আর আমি মনে গেঁথে নেই। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, অত্যধিক শীতের সময়ও যখন ওয়াহী নাযিল হত, হুজুরের শরীরে তাপ সঞ্চয় হত এবং তাঁর চেহারা মোবারকে ঘাম দেখা যেত।
উপোরোক্ত দুই ধরনের বাইরেও কখনও কখনও আল্লাহ কোন মাধ্যম ব্যতিরেকেই সরাসরি পর্দার আড়াল হতে নবীদের সাথে কথা বলেছেন।
বুখারী শরীফের ওয়াহী সম্পর্কীয় হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা আইনী তাঁর গ্রন্থে ওয়াহীর বিভাগ সম্পর্কে নিম্নরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন,
(১) আল্লাহ কোন প্রকার মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি কথা বলতেন। যেমন পবিত্র কোরআন এবং বিশুদ্ধ হাদীসের বর্ণনায় জানা যায় যে, হযরত মূসা (আঃ) এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর সাথে আল্লাহ এ ধরনের কথোপকথণ করেছেন।
(২) কোন ফিরিশ্তা পাঠিয়ে তাঁর মাধ্যেমে ওয়াহী নাযিল করতেন।
(৩) অন্তরে ওয়াহীর শব্দসমূহ ধ্বনিত করে বিঁধে দেন। যেমন হুজুর বলেছেনঃ “পবিত্র ফিরিশতা আমার অন্তরে দম করে দিয়েছেন”। হযরত দাউদের (আঃ) উপরে তৃতীয় ধরনের ওয়াহী নাযিল হত।
কোরআন নাযিল হওয়ার পদ্ধতিঃ কোরআনকে বুঝা এবং তাকে হৃদয়ঙ্গম করার নিমিত্ত কোরআন নাযিল হওয়ার পদ্ধতি অনুধাবন করা অপরিহার্য। মনে রাখা দরকার যে, কোরআন গ্রন্থাগারে একই সময় নবী করীমের (সঃ) উপরে অবতীর্ণ হয়নি। বরং যে বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব নবী (সঃ) এবং তার আত্মোৎসর্গিত সাথীদের উপরে আল্লাহ চাপিয়ে দিলেন, সেই আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে অল্প অল্প প্রয়োজনানুসারে পূর্ণ তেইশ বৎসর কালব্যাপী অবতীর্ণ হয়েছে।
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত প্রাপ্ত হন এবং পূর্ণ তেইশ বছর কাল নবী হিসেবে খোদা প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করে তেষট্টি বছর বয়সে দুনিয়া ত্যাগ করেন। এই সুদীর্ঘ তেইশ বৎসর কালব্যাপী বিভিন্ন পর্যায় কোরআনের বিভিন্ন অংশ আল্লাহর রসূলের প্রতি অবতীর্ণ হতে থাকে।
মক্কী-মাদানীঃ নবুয়াত প্রাপ্তির পরে হযরত (সঃ) তের বৎসরকাল মক্কা শরীফে অবস্থান করেন এবং মক্কা ও উহার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। মক্কায় অবস্থানকালীন এই দীর্ঘ তের বছরে যে সব সূরা নবীর (সঃ) উপরে অবতীর্ণ হয়েছে তাকে বলা হয় মক্কী সূরা।
অতঃপর আল্লাহর নবী মদীনা শরীফে হিযরত করেন এবং দীর্ঘ দশ বছরকাল মদীনায় অবস্থান করে ইমলামকে একটি জীবন্ত-বিধান হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে পরকালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মদীনায় অবস্থানকালীন এই দশ বছর কালব্যাপী কোরআন মজীদের যে সব সূরা হযরত (রঃ) উপরে অবতীর্ণ হয়েছে উহাকে বলা হয় মাদানী সূরা।
মক্কী সূরাসমুহের বৈশিষ্ট্যঃ ইসলামী দাওয়াতের সূচনায় মক্কা শরীফে নবী করীম (সাঃ) উপরে যে সব সূরা অবতীর্ণ হয়েছে তার অধিকাংশ ছিল আকারে ছোট অথচ অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী। সাধারনত ইসলামের মৌলিক আকীদা বিশ্বাস সম্পর্কীয় বিষয়সমুহ , যেমন তাওহীদ রিসালাত আখেরাত ইত্যাদি বিষয়ের ইহাতে যেমন আলোচনা করা হয়েছে, তেমনি শীরক কুফরী নাস্তিকতা পরকাল অস্বীকৃতি প্রভৃতি আকীদা সম্পর্কীয় প্রদান পাপ কার্যেরও উহাতে বর্ণনা দান করা হয়েছে। অতীতে যে সব জাতি নবীর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে পরকালে বিশ্বাস স্থাপন করত একমাত্র আল্লাহর প্রদত্ত দ্বীন অনুসারে চলে দুনিয়ায়ও অশেষ কল্যাণ লাভ করেছে এবং পরকালেও অনন্ত সুখের অধিকারী হবে, তাদের সম্পর্কে যেমন ইহাতে আলোচনা করা হয়েছে তেমনি আলোচনা করা হয়েছে সেই সমস্ত ভাগ্যহীনদের সম্পর্কে যারা নবীর দাওয়াতকে অস্বীকার করে আল্লাহর দ্বীনকে প্রত্যাখ্যান করে দুনিয়ায়ও ধ্বংস হয়েছে এবং পরকালেও চরম শাস্তি ভোগ করবে। আর এই ঘটনাগুলি বর্ণনা করা হয়েছে উহা হতে উপদেশ গ্রহণ করার জন্য, ইতিহাস আলোচনার জন্য নয়।
এ ছাড়াও মক্কী সূরাতে রসূল (সঃ) এবং তাঁর মুষ্টিমেয় সাথীদেরকে কাফির ও মুশরিকদের অবিরাম নির্যাতনের মুখে যেমন ধৈর্য ধারণ করার নছিহত করা হযেছে, তেমনি কাফির-মুশরিকদেরকেও তাদের হঠকারিতা ও বাড়াবাড়ির ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে।
মাদানী সূরাসমূহের বৈশিষ্ট্যঃ মহানবীর (সঃ) মাদানী জীবনের সূচনা হয় নবুয়তের তের বছর পরে। মক্কা মরীফে রসুলের দাওয়াতে যারা ইসলাম কবুল করেছিলেন, তারা যেমন ছিলেন প্রভাবহীন, তেমনি ছিলেন সংখ্যায় নগন্য। কোরায়েশ এবং মক্কার পার্শ্ববর্তী গোত্রসমূহের নেতৃস্থানীয় লোকেরা ছিল রসুলের দাওয়াতের ঘোরতর বিরোধী।
ফলে মুসলমানদেরকে সেখানে কুফরী প্রভাবের অধীনে যথেষ্ট নির্যাতিত জীবন যাপন করতে হয়েছে। কিন্তু মদীনার অবস্থা ছিল ইহার সম্পূর্ণ বিপরিত। মদীনায় দুটি প্রভাবশালী গোত্র ‘আওচ ও খাজরাজের’ নেতৃস্থানীয় লোকেরা ইতিপূর্বে হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় এসে রসুলের কাছে ইসলাম গ্রহণ করে গিয়েছিলেন। আর তাদেরই অনুসরণে গোত্রের প্রায় সব লোকেরাই ইসলাম কবুল করে ফেলেছিলেন।
অতঃপর নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে হুজুর যখন তাঁর সঙ্গীদেরকে নিয়ে মদীনায় হিজরত করলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন যে, মদীনার প্রভাবশালী নেতা এবং তাদের এলাকাটাও হুজুরের নিয়ন্ত্রনে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। ফলে ইসলামের যাবতীয় বিধানমালা কার্যকর করার ব্যাপারে বাহিরের হস্তক্ষেপ ব্যতিত ভিতরের দিক থেকে আর তাকে কোন প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে হবে না। মদীনায় ইহুদিদের যে দুটি গোত্র বাস করত, ইতিপূর্বে রসূল (সঃ) তাদেরকে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ করে ফেলেছিলেন।
সুতরাং আল্লাহর নবী কালবিলম্ব না করে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার নিমিত্ত ছোট অথচ সম্ভাবনাময় একটি ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ স্থাপন করলেন। এখন প্রয়োজন ছিল এই রাষ্ট্রের পরিচালনার জন্য যাবতীয় বিধি-ব্যবস্থার। উহাই পর্যায়ক্রমে মাদানী সূরাসমূহের মাধ্যমে নবীর জীবনের বাকী দশ বছরে অবতীর্ণ থাকে।
রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা সম্পর্কিয় যাবতীয় মৌলিক আইন, যেমন ফৌজদারী কানুন, উত্তরাধিকারী সম্পর্কীয় আইন, বিবাহ-তালাক সম্পর্কীয় বিধি ব্যবস্থা, জাকাত-ওশর প্রভৃতি অর্থনৈতিক বিধান এবং যুদ্ধ-সন্ধি সম্পর্কীয় হুকুম-আহকাম হল মাদানী সূরাসমূহের প্রধান আলোচ্য বিষয়।
মক্কায় কোন ইহুদি গোত্র বাস করতে না এবং মুনাফেকদেরও (সুবিধাবাদী শ্রেণী) কোন সংগঠিত দল তথায় ছিল না। ফলে মক্কী সূরাসমূহে এদের সম্পর্কে বিশেষ কোন আলোচনা দেখা যায় না। কিন্তু মদীনায় এ দুটি শ্রেণীই ছিল এবং বাহ্যিক দিক দিয়ে এরা মুসলমানদের শুভাকাঙ্খী বলে নিজেদেরকে জাহির করলেও ভিতরে ভিতরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ফলে আল্লাহ মাদানী সূরাসমূহের মাধ্যমেই এদের কুটিল ষড়যন্ত্রের কথা নবীকে জানিয়ে দেন এবং ইহুদি ও মোনাফেকদেরকে তাদের জঘন্য পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করে দেন।
আরববাসীদের উপর কোরআনের আশ্চর্য প্রভাবঃ কোরায়েশদের শত বাধা সত্ত্বেও দিন দিন যে ইসলামের প্রভাব আশ্চর্যজনকভাবে বেড়ে চলছিল তার মূলে ছিল পবিত্র কোরআনের অলৌকিক প্রভাব। নিম্নের ঘটনা কয়টিই উহার বাস্তবতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।
প্রথম দিকে প্রায় তিন বছর কাল হুজুর (সঃ) ইসলামের দাওয়াত গোপনে দিতে থাকেন। অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে তিনি প্রকাশ্য দাওয়াতের সূচনা করেন, আর এই সময়ই শুরু হয় কোরায়েশদের সাথে সংঘাত। এ সময় কোরায়েশরা একদিকে মুহাম্মদের (সঃ) দরিদ্র ও দুর্বল সাথীদের পরে নানারূপ শারীরিক নির্যাতন শুরু করে এবং অন্যদিকে স্বয়ং হযরত মুহাম্মদকে (সঃ) নানারূপ প্রলোভন দ্বারা সত্য পথ হতে বিরত রাখার চেষ্টা করে।
নবুয়তের পঞ্চম বর্ষে কোরায়েশ নেতাদের প্রস্তাবক্রমে তাদের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ওৎবা বিন রাবিয়াকে হযরত মুহাম্মদের (সঃ) নিকট একটি আপোষ প্রস্তাব নিয়ে পাঠান হয়। ওৎবা হুজুরের খেদমতে হাজির হয়ে এই মর্মে প্রস্তাব পেশ করে যে, “হে মুহাম্মদ (সঃ) তুমি এ নতুন মতবাদ পরিত্যাগ কর , তাহলে তোমাকে আমাদের নেতা করে নেব। যদি তুমি ধনের আকাঙ্খা কর, তাহলে আমরা তোমাকে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী করে দেব আর যদি তুমি সুন্দরী মহিলার লোভ রাখ, তাহলেও আমরা তোমার সে বাসনা পূর্ণ করে দেব”। হুজুর বললেন, নেতৃত্ব, ধন আর নারী কেন। তোমরা যদি আমার এক হাতে আকাশের সূর্য ও অন্য হতে চন্দ্রও এনে দাও তবুও আমি এ মতবাদ ত্যাগ করতে পারব না। অতঃপর হুজুর সূরায়ে হাঁমিমের কয়েকটি আয়াত তার সামনে তেলওয়াত করলেন।
ওৎবা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উহা শ্রবণ করল। তার বাকশক্তি হয়ে গেল এবং ভিতর হতে সে তার সমস্ত শক্তি ও সাহস হারিয়ে ফেলল। অতঃপর সে সেখানে ফিরে গেল, যেখানে কোরায়েশ দলপতিরা তার পথ চেয়েছিল এবং মনে মনে একটি শুভ সংবাদের আশা করছিল।
ওৎবা কোরায়েশ নেতাদেরকে লক্ষ করে বলল, দেখ তোমরা মুহাম্মদকে বাধা দিও না। অতঃপর যখন তাঁর দাওয়াত কোরায়েশদের এলাকার বাইরে চলে যাবে, তখন অ-কোরায়েশদের সাথে মুহাম্মদের (সঃ) সংঘর্ষ হবে। সে সংঘর্ষে যদি মুহাম্মদ (সঃ) পর্যুদস্ত হয়, তাহলেও তোমাদের লাভ। কেননা তোমাদের শত্রু ধ্বংস হল, অথচ তোমাদেরকে সংঘাতে লিপ্ত হতে হল না। আর যদি মুহাম্মদ (সঃ) জয়ী হয়, তাহলেও তোমাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। কেননা তোমাদের কোরায়েশ বংশেরই একটি লোক আরবদের নেতা হবে।
এহেন প্রস্তাবে উপস্থিত নেতারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল এবং অনুসন্ধান করে জানতে পারল যে, মুহাম্মদের (সঃ) মুখ নিঃসৃত কোরআনের বানী শুনেই ওৎবা অভিভূত হয়ে পড়েছে, ফলে মুহাম্মদের সম্পর্কে সে নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করেছে।
অনুরূপ আর একটি ঘটনা ঘটে আবিসিনিয়ায়। তখন নবুয়তের পঞ্চম বর্ষ। কোরায়েশদের উৎপীড়নে জর্জরিত হয়ে হুজুর (সঃ) প্রথমে ষোলজন এবং পরে তিরাশিজন মুসলমান নর-নারীর দুটি দলকে আবিসিনিয়ায় প্রেরণ করেন। আবিসিনিয়ার ইসায়ী শাসক নাজাশী ছিলেন অত্যন্ত সুবিচারক এবং প্রজাবৎসল। তিনি মুসলমানদেরকে তার দেশে বসবাসের আদেশ দিলেন। এদিকে কোরায়েশ সর্দারগণ এটা জানতে পেরে একটি যোগ্য প্রতিনিধি দলকে প্রচুর উপঢৌকনসহ নাজাশীর দরবারে পাঠাল। তারা নাজাশীর খেদমতে হাজির হয়ে উপঢৌকন পেশ করে বলল, মহারাজ, আমাদের কিছু যুবক-যুবতী কিছু গোলাম আমাদের নেতাদের অবাধ্য হয়ে তাদের অনুমতি (ছাড়পত্র) ছাড়াই আপনার দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদেরকে ফেরৎ নেয়ার জন্যই আমাদেরকে আপনার খেদমতে পাঠান হয়েছে। দয়া করে আপনি তাদেরকে আমাদেরকে হাতে সমর্পণ করবেন। দরবারীরাও পলাতকদেরকে ফেরৎ দেয়ার পক্ষে মত দিলেন। কিন্তু বাদশাহ্ বললেন, তাদের বক্তব্য না শুনে আমি তাদেরকে ফেরত দিতে পারিনা। অতঃপর তাদেরকে ডাকা হল এবং কেন তারা দেশ ত্যাগ করে এসেছে তা বলতে বলা হল।
মুসলিম দলের নেতা হযরত আলীর ভ্রাতা হযরত জাফর দাঁড়িয়ে বললেন, জাহাঁপনা’ আমরা ইতিপূর্বে মূর্তিপূজাসহ নানারূপ কুসংস্কারে লিপ্ত ছিলাম। মারামারি, খুন-খারাবী, রাহাজানী ও লুটতরাজ ছিল আমাদের নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ। ইতিমধ্যে আল্লাহ মেহেরবানী করে আমাদের ভিতরে একজন নবী পাঠালেন। তিনি আমাদেরকে একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণ করতে, সত্য কথা বলতে, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে, গরীব মিসকিনদের প্রতি সদয় হতে এবং খুন-খারাবী ও লুটতরাজ পরিত্যাগ করে পবিত্র জীবন-যাপন করতে আহ্বান জানালেন। আমরা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার দ্বীন গ্রহণ করি। ফলে আমাদের গোত্র নেতারা আমাদের প্রতি রুষ্ট হয়ে আমাদেরকে নানারূপ নির্যাতন শুরু করে। আমরা তাদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের পয়গাম্বরের আদেশে আপনার দেশে হিজরত করে এসেছি। এখন যদি আপনি আমাদেরকে এই কোরায়েশ দূতদের হাতে অর্পণ করেন তাহলে আমাদের আর কোন উপায় থাকবে না।
বাদশাহ হযরত জাফরের এই তেজস্বীনি ও হৃদয়স্পর্শী বক্তব্য শুনে খুবই প্রীত হলেন এবং বললেন, তোমাদের পয়গাম্বরের উপরে যে কালাম অবতীর্ণ হয়েছে তার কিছু আমাকে শুনাতে পার? হযরত জাফর, হযরত ঈসা ও হযরত মরিয়ম সম্পর্কীয় সূরায়ে মরিয়মের কয়েকটি আয়াত সুললিত কন্ঠে পাঠ করে তাকে শুনালেন। নাজাশীর দু’চোখ গড়িয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে লাগল। তিনি অন্তরে এক স্বর্গীয়-শান্তি অনুভব করলেন এবং বললেনঃ সৃষ্টিকর্তার শপথ ইঞ্জিল আর যে কালাম এখন আমাকে শুনান হল উভয়ই একই মূল হতে এসেছে।
অতঃপর তিনি কোরয়েশ দূতগণকে লক্ষ্য করে বললেনঃ ফিরে যাও আমি এ নিরপরাধ লোকগুলিকে তোমাদের হাতে অর্পণ করতে পারব না।
এদিকে কোরায়েশরা অধীর আগ্রহে দূতদের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করেছিল তারা ভেবেছিল পলাতক লোকগুলোকে বন্দী অবস্থায় নিয়ে দূতগণ মক্কায় ফিরবে। কিন্তু দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরে দূতগণ যখন খালি হাতে ফিরে এল, তখন তারা আশ্চর্য হয়ে এর কারণ জানতে চাইল। দূতগণ বললঃ জাফরের মুখে কোরআন শুনেই বাদশাহ বিগড়ে গেলেন। নতুবা আমরা তাদেরকে ফেরৎ আনতে পারতাম।
কোরায়েশরা আর একবার অনুভব করল যে, কোরআনের অলৌকিক প্রভাবেই তাদের সর্বনাশের মূল কারণ।
কোরআন শুনে কোরআনের অলৌকিক প্রভাবে অভিভূত হয়ে নবুয়তের প্রথম দিকে যারা ঈমান এনেছিলেন, তাদের ভিতরে দক্ষিণ আরবস্তু ইয়ামানী কবি তোফায়েল ইবনে দোসীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আরবে তখন কবিদের যথেষ্ট মর্যাদা দেয়া হত। ফলে তোফায়েল ইবনে দোসীর ইসলাম গ্রহণে সারা আরব দেশে এক তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে দোসী গোত্রে সমস্ত লোকই তার প্রভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন।
বনি সলিম গোত্রের বিজ্ঞ ব্যক্তি কায়েস ইবনে নাসিরাও হুজুরের মুখনিঃসৃত কোরআন শুনে ইসলাম কবুল করেছিলেন। পরে তিনি বাড়ী ফিরে গিয়ে তার গোত্রের লোকদের একত্র করে বললেন, দেখ, রোম ও পারস্যের সেরা কবি সাহিত্যকদের কথাবার্তা ও রচনাদি শুনার ভাগ্য আমার হয়েছে, হামিরের খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের কথাবার্তাও আমি ঢের শুনেছি। কিন্তু মুহাম্মদের মুখনিঃসৃত কোরআনের বাণীর সমতুল্য আমি কারো কাছেই কিছু শুনি নাই। পরবর্তী সময় তাঁর প্রচেষ্টায় তাঁর গোত্রের প্রায় এক হাজার লোক ইসলাম কবুল করেছিলেন।
আজাদ গোত্রের সর্দার জামাদ ইবনে ছায়ালাবাও নবীর মুখে কোরআন শুনে ইসলাম গ্রহণ করেন। নেতৃস্থানীয় কোরায়েশ যুবকদের ভিতরে হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণও ছিল কোরআনের অলৌকিক প্রভাবে। ঘটনাটি ছিল নিম্নরুপঃ
নবুয়তের তখন নবম বর্ষ। আবু জাহেল দ্বারে-নোদ্য়ায়ে কোরায়েশ নেতাদের এক সম্মেলন ডাকল। অতঃপর সকলকে লক্ষ্য করে জ্বালাময়ী ভাষায় মুহাম্মদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে একটি নাতি-দীর্ঘ বক্তৃতা করল। আর কোরায়েশ যুবকদের এই বলে উসকাল, এই একটি মাত্র লোক আমাদের জাতিধর্ম ইত্যাদি সবকিছু ওলট-পালট করে দিল। অথচ কেউ এ শত্রুকে নিপাত করতে পারল না। আমি আজ জনসমক্ষে ঘোষণা করছি, যে বীর যুবক মুহাম্মদের (সঃ) ছিন্ন মস্তক আমাদের কাছে হাজির করতে পারবে। আমি তাকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা এবং একশত উট পুরস্কার দিব।
ঘোষনার সাথে সাথে উত্তেজিত জনতার ভিতর হতে বলিষ্ট দেহ বিশাল বক্ষ, যুবক উমর নাংগা তলোয়ার হাতে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বললঃ এই আমিই যাই, মুহাম্মদের ছিন্ন মস্তক না নিয়ে আর ফিরব না। জনতা হর্ষধ্বনি করে উঠল, আর মহাবীর উমর তলোয়ার নিয়ে রওয়ানা হলো।
পথিমধ্যে বন্ধু নঈমের সাথে তার সাক্ষাৎ হলো। নঈম উমরের এই ক্রোধাবস্থা লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল- এ অসময় উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে তুমি কার সর্বনাশ করতে বের হয়েছো? বলল, মুহাম্মদের (সঃ) মন্ডুপাত করতে। সে আমাদের সবকিছূই ওলট-পালট করে দিয়েছে।
নঈম যে গোপনে ইসলাম কবুল করেছিলেন, উমর তা জানত না। নঈম রসূলকে (সঃ) উমরের আক্রোশ হতে বাঁচবার জন্যে বললেন, তোমার ভগ্নি ফতেমা এবং ভগ্নিপতি সাঈদও যে ইসলাম কবুল করেছে। উমর আঁতকে উঠে বললঃ হায় সর্বনাশ! আমারই ঘরে? আমি এক্ষনই ঠিক করে দেব, এই বলে সে বোনের বাড়ীর দিকে রওনা হল।
তখন মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ। সাঈদ ও ফাতিমা কোরআনের লিখিত কিছু অংশ পাঠ করছিলেন। হঠাৎ উমরের আগমনধ্বনি শুনে তারা উহা লূকিয়ে ফেললেন। উমর জিজ্ঞেস করলেন এই মাত্র কি পাঠ করছিলে। ফাতিমা বললেন, কই তুমি কি শুনেছ? উমর ক্রোধভরে সাঈদের উপরে ঝাপিয়ে পড়ে তাকে প্রহার শুরু করল। আর বলল, মুহাম্মদের দ্বীন কবুল করেছ, এবার মজা দেখে নাও। ফাতিমা ঠেকাতে গিয়ে আহত হল। তার জখম হতে রক্ত ঝরছিল। উমর রক্ত দেখে থমকে দাঁড়াল এবং বলল, হতভাগিনী মুহাম্মদের (সঃ) দ্বীন কবুল করেছিস? ফাতিমাও ছিল মহাবীর খাত্তাবের মেয়ে। জখম হয়ে নির্ভীক কন্ঠে উত্তর দিলেন, তুমি যত পার মার। মুহাম্মদের (সঃ) দ্বীন কবুল করেছি, তা পরিত্যাগ করব না। বোনের এই কঠোর ও নির্ভীক উক্তিতে উমর সচকিহ হল এবং বলল, তোমরা যা পাঠ করেছিলে তা আমাকে দাও। ফাতিমা উত্তর দিলেন আগে তুমি অজু করে পবিত্র হও তারপরে দেব। উমর পবিত্র হওয়ার পরে তাকে তা দেয়া হল। এতে সূরায়ে তোয়াহার অংশ বিশেষ লেখা ছিল। উমর মনোনিবেশ সহকারে তা পাঠ করল। অতঃপর তার ভাষা ও অন্তর্নিহিত ভাব উমরকে একেবারেই অভিভূত করে ফেলল। সে একান্তভাবে অনুভব করল যে, এ কালাম কিছুতেই মানব রচিত নয়। কম্পিত কন্ঠে উমর ঘোষণা করলেন,
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর রসূল।
হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণের খবর বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ল। ওদিকে দ্বারে নোদওয়ায়ে মুহাম্মদের ছিন্ন মস্তক হস্তে মহাবীর উমরের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় যারা ছিল, তাদের মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হল। তারা বুঝতেই পারল না যে, এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন কি ঘটনা ঘটল, যার ফলে মাথা নিতে গিয়ে মাথা দিয়ে আসলো।
অনুসন্ধান করে জানল, বোনের বাড়ীতে কোরআন পাঠ করেই তাঁর এ দুর্দশা। কোরায়েশরা আর একবার চরমভাবে অনুভব করল যে, কোরআনই তাদের সব অঘটনের মূল।
প্রসিদ্ধ ছাহাবী হযরত জোবায়ের ইবনে মোতেমও কোরআন শুনে ইসলাম কবুল করেছিলেন। এসব ঘটনা দৃষ্টে কাফের ও মুশরেক নেতাদের আর বুঝতে বাকী থাকল না যে, কোরআনের কারণেই তাদের এ বিপর্যয়। মুহাম্মদ (সঃ) তো কোরআন নাযিলের আগেও তাদের ভিতরে ছিল। কিন্তু কই, তখন তো সে তাদের জাতি বা সমাজের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। কোরআন অবর্তীনের পর হতেই তো তাদের এ বিপর্যয়। কোরআন শুনে ওৎবার মত প্রখর বুদ্ধিমান লোকটি বুদ্ধি হারিয়ে ফেলল। আবার এই কোরআনের আকর্ষণেই নাজাশী কোরায়েশ দূতদেরকে খালি হাতে ফেরৎ দিল, উমরের মত পাষাণ হৃদয় কোরআনের যাদু স্পর্শে মাথা নিতে গিয়ে মাথা দিয়ে আসল। প্রসিদ্ধ কবি তোফায়েল-বিন দোসী, জামাদ, জোবায়ের প্রভৃতি গোত্র সর্দারগণ কোরআনের বাণীতে মুগ্ধ হয়েই ইসলামের কোলে আশ্রয় নিল।
সুতরাং কাফের সর্দারগণ পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, তারা নিজেরাও কোরআন শুনবে না এবং কোরআনের আওয়াজ যাতে কোন লোকের কানে না পৌছে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
আল্লাহ তাদের এ সিদ্ধান্তের কথা নিম্নলিখিত আয়াত দ্বারা রাসূলকে জানিলে দিলেন।
১। কোরআনের এই অলৌকিক প্রভাবের কথা স্বীকার করে প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্য পন্ডিত ইমানুয়েল ডুয়েৎচ বলেছেন, ”এই পুস্তকখানার সাহায্যেই আরবরা আলেকজান্ডার ও রোম অপেক্ষাও বৃহত্তর ভূ-ভাগ জয় করতে সক্ষম হয়েছিল। রোমের যত শত বছর লেগেছিল তাদের বিজয় সম্পূর্ণ করতে আরবদের লেগেছিল তত দশক। এরই (কোরআনের) সাহায্যে সমস্ত সেমিটিক জাতির মধ্যে কেবল আরবরাই এসেছিল ইউরোপের রাজারূপে। নতুবা ফিনিসীয়রা এসেছিল বনিক রূপে। আর ইহুদীরা পলাতক কিংবা বন্দীরূপে।” “আর কাফেররা বলে, কেহই কোরআন শুন না এবং কোরআন তেলওয়াতের সময় শোর-গোলকর, তাহলেই তোমাদের পরিকল্পনা কার্যকরী হবে। আমি এ সব কাফেরদেরকে কঠোর শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করার এবং তাদেরকে এ অপকর্মের উপযুক্ত প্রতিফল দেব। (সূরা হামিম সিজদা আয়াত নং ২৬,২৭)
কোরআনের ঐশীগ্রন্থ হওয়ার কয়েকটি অকাট্য প্রমাণঃ পবিত্র কোরআন যে আল্লাহ তায়ালারই বাণী এবং এই ধরনের কিতাব যে মানুষের পক্ষে তৈরী করা আদৌ সম্ভব নয় এর অসংখ্য প্রমাণ স্বয়ং কোরআনেই বর্তমান। নিম্নে তা হতে কয়েকটি উদ্ধৃত করা হচ্ছে-
কোরআনের ভাষাগত ও সাহিত্যিক মানঃ কোরআনের ভাষাগত ও সাহিত্যিক মান অত্যন্ত উচাঙ্গের। এর ভাষা যেমন স্বচ্ছ, তেমনি এর বাক্য বিন্যাসও অত্যন্ত নিখুঁত ও অভিনব। নবী করীম (সঃ) যখন কোরআনের তেলাওয়াত করতেন তখন এর ঝংকার ও সুরমাধুরী তাঁর সমভাষীদের মন মগজকে মোহিত করে তুলত। তারা বাস্তবভাবে উপলব্ধি করত যে, এ কালাম কিছুতেই মানুষের পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয় তা সে আরবী সাহিত্যর যত বড় পন্ডিতই হোক না কেন।
যদিও পূর্ব পুরুষের অন্ধ অনুকরণ, গোত্রীয় অহমিকা ও সংকীর্ণ স্বার্থ বোধ কোরআনকে হক বলে গ্রহণ করার পথে তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতার।
সৃষ্টি করে রেখেছিল, কিন্তু তারা এ কথা ভালভাবে উপলব্ধি করত যে, একজন উম্মি লোকের পক্ষে; যে কোনদিন পাঠশালার বারান্দাও মাড়ায়নি এ ধরনের উচ্চ মানের কালাম রচনা করে পেশ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। স্বয়ং কোরআনেই একাধিকবার আরবদেরকে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ করেছে যে, তোমরা যদি একে নবীর (সঃ) রচিত বানী বলে মনে কর, তাহলে তোমরা এই ধরনের বাণী তৈরী কর দেখাও।”
মুশরিকদের প্রাণান্তকর বিরোধিতার মুখে মক্কা শরীফে বিভিন্ন সময় উক্ত চ্যালেঞ্জ তিনবার প্রদান করা হয়। রসূলদের মাদানী জিন্দেগীর প্রথম দিকে আর একবার এ চ্যালেঞ্জের পূনরোক্তি করা হয় । মক্কায় একবার সূরা ইউনুসের ভিতরে, একবার ছুরা হুদের ভিতরে এবং আর একবার সূরা বনি-ইসরাইলের ভিতরে নিম্নরূপ চ্যালেঞ্জ দান করা হয়ঃ
উহারা কি দাবী করে যে, কোরআন (আপনার) বানানো। আপনি বলুন, তোমরা যদি তোমাদের দাবীতে সত্যবাদী হও তাহলে একটি সূরা অন্তত তৈরী করে নিয়ে এস। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের সাহায্য প্রয়োজন বোধ কর। সাধ্যমত তাদেরকেও ডেকে নাও। (সূরা ইউনূস, আয়াত নং ৩৮)
উহারা নাকি বলে যে, কোরআন রসূলের (সঃ) তৈরী করা, আপনি বলুন, তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তাহলে এ ধরনের রচিত দশটি সূরা নিয়ে এসো। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত যাদের সাহায্য প্রয়োজন বোধ কর সাধ্যতম তাদেরকেও ডেকে নাও। (সূরা হুদ, আয়াত নং ১৩)
আপনি ঘোষণা করে দিন, জগতের সমগ্র মানব ও জ্বিন জাতি মিলেও যদি এ ধরনের একখানা কোরআন তৈরী করার চেষ্টা করে, তাহলেও তারা তা পারবে না, যদিও তারা এ ব্যাপারে পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে। (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত নং ৮৮)
নবী করীম (সঃ) মদীনায় হিজরত করার পরপরই আর একবার সূরায়ে বাকারার ভিতরে উক্ত চ্যালেঞ্জের পুনরাবৃত্তি নিম্নরূপে করা হয়,
আর যে কিতাব আমি আমার বান্দার (মুহাম্মদের) উপর নাযিল করেছি, তা আমার পক্ষ হতে কিনা? এ ব্যাপারে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে, তাহলে অনুরূপ একটি সূরা তৈরী করে নিয়ে এস। আর এ কাজে আল্লাহ ছাড়া তোমাদের অন্যান্য সাহায্যকারীদেরকে ডেকে নাও যদি তোমরা সত্যবাদী হও। (সূরা বাকারা, আয়াত নং ২৩)
আরবদের কঠিন বিরোধিতার মুখে যখন বার বার এ চ্যালেঞ্জ প্রদান করা হয়েছিল, তখন নিশ্চয়ই তারা চুপ করে বসেছিল না। তাদের ভিতরে বেশ কিছু বড় বড় কবি এবং উচ্চমানের সাহিত্যিক বর্তমান ছিল। এহেন প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জের জওয়াব দানের জন্যে ইসলাম বিরোধীরা এদের সকলের দ্বারেই ধর্ণা দিয়েছিল। কিন্তু তারা সকলেই তাদেরকে হতাশ করেছিল। তাদের কোন কবি কিংবা সাহিত্যিক প্রতিভার পক্ষেই কোরআনের ছোট্ট একটি সূরার অনুরূপও কোন সূরা তৈরী করে দেয়া সম্ভব হয়েছিল না।
আল্লাহ তায়ালার ঘোষিত উক্ত চ্যালেঞ্জ শুধু ঐ সময়ের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। বরং কোরআন অবতীর্ণের সময় হতে আরম্ভ করে কিয়ামত পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালব্যাপী কোরআন বিরোধীদের জন্য এটা একটি খোলা চ্যালেঞ্জ। আজও মিসর, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন প্রভৃতি দেশে আরবী বংশজাত বহু খৃস্টান ও ইহুদী পরিবার বর্তমান, যাদের মধ্যে আরবী ভাষার বড় বড় পন্ডিতও আছে। ইচ্ছা করলে তারাও এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখতে পারে। হয়তো তারা তা করে দেখেছেও। কিন্তু পূর্ববর্তীদের ন্যায় তাদের ভাগ্যে, হতাশা ছাড়া আর কিছুই জুটবে না।
আবার ভিজিট করবেন !!! ধন্যবাদ