একটি ঐতিহাসিক যোগসূত্রের সন্ধানে

একটি ঐতিহাসিক যোগসূত্রের সন্ধানে

ইবনে ইসহাক  ইবনে সিরিন, মুসা বিন নুসায়ের…

তাঁরা ইসলামি ইতিহাসের তিনজন মহান ব্যক্তি। ইবনে ইসহাক রাসুলের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সিরাত রচয়িতা, ‘সিরাতে রাসুলাল্লাহ’ প্রামাণ্য সিরাতগ্রন্থ হিসেবে আজও স্বীকৃত। ইবনে সিরিন ছিলেন ইসলামের প্রথম মনোবিজ্ঞানী এবং স্বপ্নব্যাখ্যাতা হিসেবে জগদ্বিখ্যাত। মুসা বিন নুসায়ের সেনাপতি, যিনি পশ্চিম আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চল জয় করেন এবং তার নির্দেশক্রমে আরেক সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ স্পেন জয় করেন।

এই তিনজন মহান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে। চলুন, জেনে নেয়া যাক কী সেই যোগসূত্র।

আরবে তখন বছরখানেক আগে পরলোকগত রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রাদি.)-এর শাসনকাল চলছে। তাঁর শাসনামলেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসলামের প্রচারিক ও সামরিক ভিত্তি প্রোত্থিত হয়। বিশেষত পশ্চিম আরব ও পারস্যে তিনি জোরদার অভিযান পরিচালনা করেন। পারস্য ও পশ্চিম আরবে তাঁর নির্দেশনায় বিভিন্ন যুদ্ধে প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের মতো একের পর এক বিজয় অর্জন করে নিজেকে অপরাজেয় করে তুলেছিলেন সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাদি.)। পারস্য আর রোমীয়দের কাছে খালিদ তখন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম।

৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসের শেষ দিক। ১২ হিজরি সনের জমাদিউল আউয়াল মাসের মাঝামাঝি। মধ্য-ইরাকের আনবার যুদ্ধে জয়ী হয়ে খালিদ অবরোধ করেন পার্শ্ববর্তী আরেক শহর আইনুত তামার। খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এ শহরের একটি দুর্গে আশ্রয় নেয় শহরবাসী সকলে। কিন্তু খালিদের রণকৌশলে খুব শিগগিরই পতন ঘটে দুর্গের। সকল খ্রিষ্টান আত্মসমর্পণ করে এবং শহরের পারসিক শাসনকর্তা কয়েকজন সৈন্যসমেত পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই নগরতোরণ খুলে দেয়া হয় খালিদ ও মুসলিমবাহিনীর জন্য।

ঘোড়ায় চড়ে খালিদ শহরে প্রবেশ করলেন। খেজুরের জন্য বিখ্যাত এ শহর। ‘আইনুত তামার’ মানে ‘খেজুরের বসন্ত’; এখানকার খেজুর রপ্তানি হয় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু বাজারে। শহরে প্রবেশ করে মুগ্ধ হলেন খালিদ। নগর গড়তে এবং সেটা সাজাতে পারসিকদের জুড়ি নেই। সবকিছু কেমন পরিপাটি করে সাজানো। সুন্দর সুন্দর দালানের সামনে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নগরবাসী। খালিদ তাদের অভয় দিলেন: এখানকার অধিবাসীরা সকলেই নির্দিষ্ট কর প্রদানের মাধ্যমে নিজ নিজ ধর্মপালন করতে পারবে। নগরের সকল নিরাপত্তার দায়িত্ব আজ থেকে খলিফাতুল মুসলিমিনের। এ কথা বলে তিনি সামনে এগিয়ে গেলেন।

শাসনকর্তার বাসভবনের পাশে বিরাট বিরাট স্তম্ভের ওপর নির্মিত একটি সাদা ভবন। এ ভবনের সামনে সাদা পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৪০-৫০ জন কিশোর-যুবক। খালিদ স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছে তাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। জানতে পারলেন, এই সাদা ভবনটি খ্রিষ্টানদের একটি ধর্মীয় বিদ্যাশ্রম (খ্রিষ্টান মাদরাসা)। রোম-পারস্যের বাছাই করা মেধাবী শিক্ষার্থীরা এই আশ্রমে পড়াশোনার সুযোগ পায়। ভবনের সামনে যাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে, এরাই সেই শিক্ষার্থী। ভবনের ভেতরে বিশাল পাঠাগার ও গবেষণাগার রয়েছে, যেখানে তারা পৃথিবীর নানা জ্ঞান শিক্ষালাভ করে।

সেনাপতি খালিদ (রাদি.) শুভ্র পোশাকপরা ছেলেগুলোকে দেখে চমকিত হলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, এই বিদ্যাশ্রমের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সকলকে সসম্মানে মদিনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক। তারা সেখানে গিয়ে বিদ্যার্জন ও জ্ঞানার্জনে নিজেদের সঁপে দেবে। খালিদ বুঝতে পেরেছিলেন, মদিনায় তখন কেবলই শুরু হয়েছে ইসলামি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রস্ফুটন। ‘ইকরা’ ধ্বনির মাধ্যমে যে ইসলামের সূচনা হয়েছিল, সে ইসলাম জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে আগামী পৃথিবী জয় করবে। হয়তো একদিন এই শিক্ষার্থীদের কলমের কালিতেই লেখা হবে ইসলামের অতীত ও ভবিষ্যত।

আইনুত তামার বিদ্যাশ্রমের সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে সেদিনই মদিনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। এদের অধিকাংশই পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হন।

এই বিদ্যার্থীদের মাঝে তিনজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: ইয়াসার-যিনি ছিলেন সিরাত রচয়িতা মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের দাদা। সিরিন-যিনি ছিলেন স্বপ্নব্যাখ্যাকার মুহাম্মদ ইবনে সিরিনের পিতা। নুসায়ের-যিনি ছিলেন আফ্রিকাবিজয়ী বীর মুসা ইবনে নুসায়েরের পিতা।

এরা সবাই ছিলেন আইনুত তামারের সেই বিদ্যাশ্রমের শিক্ষার্থী, যাদের পরবর্তী বংশধর ইসলামি ইতিহাসের তিন অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে আজও বরিত হয়ে আসছেন।

তথ্যসূত্র : Khalid Bin Al-Waleed Sword Of Allah by A. I. Akram

আবার ভিজিট করবেন !!! ধন্যবাদ

error: Content is protected !!
Scroll to Top