মানুষ কি পৃথিবীতে স্থিতিশীল? কিংবা যদি প্রশ্ন করি— মানুষ কি পৃথিবীর স্থায়ী বাসিন্দা? স্বাভাবিকভাবে প্রশ্নের উত্তর আমাদের সামনে প্রতিদিনই প্রস্ফুটিত— মানুষ পৃথিবীর স্থায়ী সৃষ্টি নয়।
বিষয়টি খানিক আধ্যাত্মিক পর্যায়ে চলে গেছে যদিও, কিন্তু আদতে বিষয়টি পার্থিবও। মানুষের আচরিক পৃথিবীতেও মানুষ কখনো স্থায়ী নয়, মনে ও মানসে।
ধরা যাক, একজন রিকশাওয়ালা চরিত্র। তিনি যে বস্তির ঘিঞ্জি ঘরে আপাতত বসবাস করছেন, তিনি কি তার সে অস্থায়ী ঠিকানায় চিরদিন বসবাসের চিন্তা করেন? কিংবা তিনি কি এর চেয়ে আরও ভালো কোনো জায়গার বসবাসের চিন্তা করেন না?
ধরা যাক একজন কোটিপতির কথা, গুলশানে যার প্রাসাদোপম বাড়ি এবং খাগড়াছড়িতে নয়নাভিরাম বাংলো আছে। গাজীপুরে তার বিশাল গার্মেন্ট ব্যবসা এবং ব্যাংকে অর্থবিত্ত প্রাচুর্যের আতিশয্য। এমন একজন ব্যক্তি কি তার গুলশানের ঠিকানাটি নিয়ে তৃপ্ত? না, তিনিও স্বপ্ন দেখেন সুইজারল্যান্ডের জুরিখে একটি স্টুডিও টাইপ ডুপ্লেক্স ভিলার, কিংবা দুবাইয়ের বুর্জ খলিফায় অত্যাধুনিক সুবিধা সম্বলিত একটি ফ্ল্যাটের।
মূলত শারীরিকভাবে মানুষ একটি ঠিকানায় থিতু হলেও মনোজাগতিক পৃথিবীতে মানুষ ক্রমাগত ঠিকানাহীন। প্রতিটি মানুষ প্রতিক্ষণ তার মনের মধ্যে ঠিকানা পরিবর্তন করছে। যাযাবরের মতো সে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে। তার মনে দেশ বা মানচিত্রের কোনো সীমারেখা নেই। সে কখনো কোনো দ্বীপে বসবাসের জন্য লালায়িত, কখনো পাহাড়ের নিবিড় অরণ্য তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে, সাগরের সৈকতে কান পেতে বসে থাকে দূরাগত কোনো মন্দ্রিত ডাক শুনবে বলে।
মানুষ প্রকৃতিজাত সৃষ্টি, প্রকৃতির উদার আহ্বান উপেক্ষা করার মতো ক্ষমতা তার নেই। মানুষ তাই প্রতি মুহূর্তে প্রকৃতির অমোঘ আকর্ষণের গদ্দিনশিন।
এখানে এসে কথা খানিকটা আধ্যাত্মিক দিকে চলে যাচ্ছে। সে যাক, আধ্যাত্মিক একটা পোচ আমাদের আলোচনায় যে থাকবে, সেটা আমরা লেখার শুরুতেই আঁচ করতে পেরেছিলাম।
এ কথা ধার্মিক-বিধর্মী সবাই জানি যে, পৃথিবীতে মানুষের আয়ুষ্কাল সংক্ষিপ্ত। মৃত্যুশীল ধারায় প্রতিটি মানুষই একদিন পৃথিবী থেকে চলে যাবে। মানুষ কোথায় যাবে? যারা ধর্মবিশ্বাসী তারা বলবেন, পরকালে বেহেশত বা দোজখে। আর যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করার ভাগ্য এখনও অর্জন করতে পারেনি তারা বলবেন, মাটির দেহ একদিন মাটিতেই মিশে যাবে। মানুষ যেভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে, সেভাবেই একদিন প্রাকৃতিক উপায়ে পৃথিবী থেকে চলে যাবে। কোনো পুনরুত্থান বা পুনর্জন্ম নেই। অল অ্যাবাউট ন্যাচারাল ক্রিয়েশন অন আর্থ!
অবিশ্বসীদের কথা একটু ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক। মানুষের ভেতরে যে প্রাণ আছে, সেটার অস্তিত্ব বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সকলেই স্বীকার করবেন। এখন আমি যদি বলি, এই প্রাণের একটি নমুনা আমার সামনে পেশ করা হোক! সম্ভব? বস্তুত প্রাণ বলতে কি পৃথিবীতে কিছু আছে? আমরা বলি বুকের মাঝে যে হৃৎপিণ্ড, সেই পিণ্ডের ভেতরে আমাদের প্রাণ, হার্ট। সেখানে অক্সিজেন শোষণ করা হয়, প্রাণের প্রয়োজনে আমরা নিঃশ্বাস নেই। কিন্তু প্রাণ জিনিসটার কি কোনো অস্তিত্ব ধরতে পেরেছি? হৃৎপিণ্ডের অস্তিত্ব আছে, লাল-খয়েরি রঙের এক তাল মাংসপিণ্ড কেবল। কিন্তু এখানে প্রাণ জিনিসটি কোনটি, যার কারণে আমাকে প্রাণী বলা হচ্ছে!
সুতরাং ‘প্রাণ’-এর কাঠামোগত কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু তবুও আমরা প্রাণের জোরেই বেঁচে আছি। এর মানে ‘প্রাণ’ কাঠামোগত কোনো বস্তুবিশেষ না হলেও বায়বীয়ভাবে এর একটি অস্তিত্ব আছে। বায়বীয় বলতে বাধ্য হচ্ছি, নয়তো বলতাম প্রাণের স্পিরিচুয়াল বা আত্মিক অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু অবিশ্বাসীরা যেখানে ঈশ্বরই মান্য করে না, সেখানে স্পিরিচুয়ালিটি বা আত্মিক সংশ্লেষের উদ্বোধন করাটা বৃথা।
যাকগে, এখন আমার প্রশ্ন হলো, এই যে অস্তিত্বহীন প্রাণ জিনিসটা, মানুষের মৃত্যুর পর এই জিনিসটার কী হবে? এটাও কি মরে যাবে? মাটির সাথে মিশে যাবে? বায়বীয় অস্তিত্ব থেকে মুহূর্তেই ফস… শূন্যে ভ্যানিশ হয়ে যাবে? নাকি… সামথিং এলস?
পশুর প্রাণ আছে, পাখির প্রাণ আছে, গাছের প্রাণ আছে… জীবজগতের প্রতিটি প্রাণি প্রাণশীল। এই লক্ষ-কোটি প্রাণ শুধুমাত্র যৌগিক অক্সিজেন শোষণের মাধ্যমেই বেঁচে আছে? এখানে আত্মিক কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই? কোথায় থাকে এই প্রাণ? দেহের মৃত্যুর পর কোথায় যায় সে? জীবিত থাকতে প্রাণ আছে বলে তাকে প্রাণী বলো, প্রাণ চলে গেলেই বলো মৃত, লাশ! তাহলে প্রাণের অস্তিত্ব কীভাবে অস্বীকার করবে? মানবিক শরীর তো কাঠামোবেজড, তার নাশ আছে। কিন্তু প্রাণ তো ফিজিক্সের কাঠামোগত টেবিলের বাইরে, তার কী হয়? তার কি নাশ আছে?
শুধুমাত্র এই প্রাণশীল প্রজাতির প্রাণের অস্তিত্ব যদি স্বীকার করতে হয় তাহলে তাদের প্রাণের একটা সদ্গতি না করলেই নয়।
পৃথিবীতে প্রাণির ডিএনএ আবিষ্কারের ঘটনা খুব সাম্প্রতিক। ডিএনএ হলো একটি প্রাণির সম্পূর্ণ জীবনপ্রণালির বিস্তারিত ডাটাবেজ। প্রাণবিক দেহের সকল তথ্য বের করা সম্ভব মানুষের ক্ষুদ্র ডিএনএ-র মাধ্যমে। এই ডিএনএ পরীক্ষা করার জন্য কিন্তু মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না বা তার উপর বিরাট রিসার্স করারও প্রয়োজন হয় না। মানুষের এক বিন্দু রক্ত, একটি চুল বা নখ এমনকি থুতু থেকেও মানুষের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তার সম্পূর্ণ জীবনপ্রণালির ডাটাবেজ প্রকাশ করা সম্ভব।
এ হলো সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার। এবার কি আমরা একবার চিন্তা করবো মাটির সঙ্গে প্রাণবিক প্রাণীর মিশে যাওয়া তত্ত্ব নিয়ে? করতে পারি। ছয় হাজার বছর আগে নুহের প্লাবনের সময় হাঁসটি মারা গিয়েছিলো, তার প্রাণের ডিএনএ আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত আছে। চার হাজার বছর আগে বনি ইসরাইলদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছিলো তাদের ডিএনএ-ও সংরক্ষিত আছে সপ্তাকাশের উপর ‘বারজাখ’ নামের বিশেষায়িত ল্যাবে। যে মারা গেলো গতকাল, তার ডিএনএ-ও সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে সে ল্যাবে। যখন পরকাল সংঘটিত হবে, আল্লাহ প্রতিটি প্রাণের ডিএনএ-র মধ্যে নতুন করে বলবেন ‘হয়ে যাও’ আর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি ডিএনএ অনুযায়ী একেকজন পরিপূর্ণ মানুষ জীবিত হয়ে যাবে।
আব্দুল্লাহ, রিচার্ড, রাহুল, ডি কস্টা… সকল ধর্মের সকল মানুষকে আল্লাহ নিজের ল্যাবে সংরক্ষিত ডিএনএ অনুসারে পুননির্মাণ করবেন। কারো সৃষ্টিতে সামান্যতম পরিবর্তন হবে না। কেননা, প্রত্যেককে নতুন করে নির্মাণের ডিএনএ ব্লু-প্রিন্ট তাঁর কাছে আগেই সংরক্ষিত রয়েছে। তিনি শুধু সে ব্লু-প্রিন্টের নকশার ওপর ঢেলে দেবেন মাটি, ফুৎকারে ভরে দেবেন সংরক্ষিত প্রাণবিক ডিএনএ, সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয়ে যাবে খাদিজা, মেরি, সীতা, যশোধা… সেম টু সেম!
আর তখনই আল্লাহ তাদের জন্য নির্ধারণ করবেন অপরিবর্তনীয় এক ঠিকানা। এছাড়া পৃথিবীর সকল ঠিকানাই সাময়িক বাসস্থান মাত্র, অনিবার্য কিছু নয়।
মাসিক নবধ্বনি, আগস্ট ২০১৭ সংখ্যা থেকে
আবার ভিজিট করবেন !!! ধন্যবাদ