
মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী: জীবন, কর্ম ও অবদান
✍️ জাতির জনক | স্বাধীনতা সংগ্রামী | অহিংস আন্দোলনের পথপ্রদর্শক
প্রস্তাবনা
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (২ অক্টোবর ১৮৬৯ – ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা এবং মানবতার ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।
তিনি সত্য ও অহিংসার আদর্শে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করেন।
গান্ধীজির জীবন ছিল ত্যাগ, নীতি ও মানবসেবার প্রতীক। তাঁর চিন্তা ও কর্ম শুধু ভারত নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য এক অনন্য উদাহরণ।
“অহিংসা মানবতার সর্বোচ্চ ধর্ম।” – মহাত্মা গান্ধী
প্রারম্ভিক জীবন
১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর গুজরাটের কাথিয়াবাড় প্রদেশের পোরবন্দরে এক বেনিয়া হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।
তাঁর পিতা করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন স্থানীয় রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এবং মাতা পুত্তলিবাই ছিলেন ধর্মপরায়ণ ও ব্রতনিষ্ঠা নারী।
শৈশব থেকেই গান্ধীজির চরিত্রে সত্য, সাহস ও ধর্মনিষ্ঠার শিক্ষা প্রোথিত হয়।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি কস্তুরবা গান্ধী-র সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দাম্পত্য জীবনে তাঁদের চার সন্তান জন্মগ্রহণ করে।
শিক্ষাজীবন
গান্ধীজি শৈশবেই ছিলেন কৌতূহলী ও অধ্যবসায়ী।
কাথিয়াবাড়ে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে তিনি ১৮ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
পরিবারের ইচ্ছায় তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ১৮৮৮ সালে ইংল্যান্ডে যান।
লন্ডনে কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে ১৮৯১ সালে ব্যারিস্টারি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং দেশে ফিরে আইনচর্চা শুরু করেন।
“সত্যই শিক্ষা, আর শিক্ষা মানে নিজের আত্মাকে জানা।” – গান্ধীজি
কর্মজীবন ও দক্ষিণ আফ্রিকা অধ্যায়
দেশে ফিরে গান্ধীজি প্রথমে আইন পেশায় যুক্ত হন, কিন্তু তেমন সাফল্য পাননি।
১৮৯৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মামলায় আইনজীবী হিসেবে সেখানে যান।
সেখানেই তিনি বর্ণবৈষম্যের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন এবং এই অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
বর্ণবিদ্বেষ ও বৈষম্যের প্রতিবাদে তিনি ১৮৯৪ সালে নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন এবং “সত্যাগ্রহ” নীতির মাধ্যমে আন্দোলনের সূচনা করেন।
এই অহিংস আন্দোলন ছিল পরবর্তীতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল দর্শন।
ভারতে প্রত্যাবর্তন ও রাজনৈতিক জীবন
১৯১৫ সালের ৯ জানুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে গান্ধীজি সক্রিয়ভাবে ভারতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ শুরু করেন।
তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশব্যাপী সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন।
চম্পারন ও খেদা সত্যাগ্রহ
১৯১৭ সালে চম্পারণ ও খেদা অঞ্চলে কৃষকদের ওপর ব্রিটিশ জমিদারদের অন্যায় কর ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সহযোগে এই আন্দোলন সফল হয় এবং ব্রিটিশ সরকার খাজনা আদায় বন্ধ করে বন্দীদের মুক্তি দেয়।
অসহযোগ আন্দোলন
১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড গান্ধীজিকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে “অসহযোগ ও শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ” আন্দোলনের সূচনা করেন।
১৯২১ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাহী হন এবং স্বরাজ (স্বাধীনতা)-এর দাবিতে বিদেশী পণ্য বর্জন ও স্বদেশী চরকার ব্যবহার প্রচলন করেন।
যদিও ১৯২২ সালে চৌরিচৌরা ঘটনায় সহিংসতা ঘটায় তিনি আন্দোলন প্রত্যাহার করেন।
“অসহযোগ মানে দুর্বলতা নয়, এটি সাহসের এক নতুন রূপ।” – মহাত্মা গান্ধী
লবণ সত্যাগ্রহ ও স্বরাজ আন্দোলন
১৯২৮ সালে ব্রিটিশদের কাছে ডোমিনিয়ন মর্যাদা দাবির মাধ্যমে গান্ধীজি পূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
১৯৩০ সালের ১২ মার্চ তিনি লবণ করের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ডান্ডি অভিযান শুরু করেন।
৪০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে সমুদ্রতীরে গিয়ে তিনি নিজ হাতে লবণ তৈরি করেন — যা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে।
এই আন্দোলনে প্রায় ৬০,০০০ ভারতীয়কে গ্রেফতার করা হয়, তবুও এর প্রভাব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
শিক্ষানীতি ও দর্শন
গান্ধীজি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল জ্ঞান অর্জন নয়, বরং চরিত্র গঠন।
তিনি ছিলেন বুনিয়াদি শিক্ষা ও শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রবক্তা।
তাঁর মতে, শিক্ষা হবে জীবনমুখী, কর্মমুখী ও আত্মনির্ভরশীল।
তিনি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্যবাদে বিশ্বাস করতেন।
“যে শিক্ষা মানুষকে নিজের ও সমাজের কাজে লাগতে শেখায়, সেই শিক্ষা-ই সত্যিকার শিক্ষা।” – গান্ধীজি
সম্মান ও প্রভাব
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন মহাত্মা নামে।
তিনি ছিলেন অহিংসার আন্তর্জাতিক প্রতীক, যাঁর আদর্শ অনুসরণ করেছেন নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রসহ বিশ্বের বহু নেতা।
ভারতের সরকার ২ অক্টোবর তাঁর জন্মদিনকে “গান্ধী জয়ন্তী” হিসেবে পালন করে।
২০০৭ সালে জাতিসংঘ ২ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস ঘোষণা করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
“আমার জীবনই আমার বার্তা।” – মহাত্মা গান্ধী
জীবনাবসান
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি দিল্লির এক প্রার্থনা সভায় গান্ধীজি এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।
তাঁর মৃত্যু ভারতবর্ষ ও মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক গভীর শোকের অধ্যায় হয়ে আছে।
তবুও তাঁর শিক্ষা, চিন্তা ও জীবনদর্শন আজও মানবতার পথে আলোকবর্তিকা হয়ে আছে।
উপসংহার
মহাত্মা গান্ধী ছিলেন সত্য, অহিংসা ও ন্যায়বোধের প্রতীক।
তাঁর নেতৃত্বে ভারত লাভ করেছিল স্বাধীনতার আলোক।
তিনি প্রমাণ করেছিলেন, শক্তির চেয়ে নীতিই বেশি কার্যকর।
তাঁর জীবন ও আদর্শ শুধু ভারত নয়, বিশ্বমানবতার ইতিহাসে চিরকাল অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
আরও পড়ুন
👉 Gandhi Official Portal
👉 International Day of Non-Violence – UN
মহাত্মা গান্ধী (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী) কর্তৃক রচিত pdf বই ডাউনলোড করতে নিচে বইয়ের নামের উপর ক্লিক করুন
১। আত্মকথা অথবা সত্যের প্রয়োগ
২। গঠনমূলক কর্মপদ্ধতি
৩। গীতা বোধ
৪। দুর্ণীতির পথে
৫। হিন্দ স্বরাজ