আকীদা পরিচিতি : ইসলামের বিশ্বাস ও তার গুরুত্ব
প্রস্তাবনা
‘আকীদা’ শব্দটি ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এটি শুধুমাত্র একটি শব্দ নয়, বরং মুসলিম জীবনের প্রাণ ও ভিত্তি। ইসলামের মূল বিশ্বাস বা আকীদা হলো মানুষের অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন ও সেই বিশ্বাসের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য। ইসলামী জীবনব্যবস্থায় আকীদার গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ একজন মুমিনের প্রকৃত পরিচয় নির্ভর করে তার আকীদার উপরে। মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআনে আমাদের ইরশাদ করেছেনঃ
“আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো, ফেরেশতাগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো, কিতাবসমূহে বিশ্বাস স্থাপন করো, নবীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো, আখিরাতের দিন বিশ্বাস স্থাপন করো এবং তাকদীরের (ভাগ্য ও নিয়তি) ভালো ও মন্দে বিশ্বাস স্থাপন করো।”
— সূরা বাকারা, আয়াত ১৭৭
আকীদার শাব্দিক পরিচয়
আকিদা শব্দটি আরবি ভাষার ‘আক্দুন’ মূলধাতু থেকে গৃহীত। এর অর্থ হলো গাঢ়ভাবে বন্ধন করা, দৃঢ়ভাবে ধারণ করা বা স্থির বিশ্বাস স্থাপন করা। প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইবনু ফারিস উল্লেখ করেন, এটি দৃঢ়করণ ও নির্ভরতার প্রতীক। এই শব্দটির ব্যবহার প্রাথমিক যুগে খুব বেশি ছিল না, বরং চতুর্থ হিজরি শতক পর ব্যাপক প্রচলিত হয়।
“শব্দের গভীর অর্থ হলো দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা। যার মাধ্যে মুমিন ব্যক্তি তার হৃদয়, মন ও কর্মে পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করে।”
— প্রখ্যাত ভাষাবিদ ইবনু ফারিস
আকিদার পারিভাষিক পরিচয়
আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-ফাইউমী (রহ.) তার গ্রন্থ আল মিসবাহুল মুনীর-এ সংজ্ঞায়িত করেছেন, আকিদা হলো ধর্ম হিসেবে যা গ্রহণ করা হয়। ইসলামী পরিভাষায় আকিদা বলতে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন এবং তা পালনের ওপর জোর দেয়া হয়। ইসলামী আকিদা হলো মানুষের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে বিশ্বাসের সঞ্চার যা তাকে মুমিন হিসেবে গড়ে তোলে।
“আকিদা মানে মুমিন ব্যক্তির জন্য মৌলিক বিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপন।”
— আল মিসবাহুল মুনীর
আকিদার ইতিহাস ও বিকাশ
আকিদা শব্দের প্রাথমিক ব্যবহার ধর্মবিশ্বাস বোঝাতে কমই দেখা যায়। কোরআন ও সহিহ হাদিসে সরাসরি আকিদা শব্দের উল্লেখ নেই। তবে ‘ইতিকাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে দৃঢ় ধারণা বোঝাতে। দ্বিতীয় শতাব্দীর ইসলামী আলিমেরা ‘ইতিকাদ’ ও ‘আকিদা’ শব্দটি ধর্মবিশ্বাস হিসেবে ব্যবহারের সূচনা করেন। চতুর্থ শতক থেকে এই শব্দটির প্রচলন বিস্তার পায়।
“আকিদার ব্যাপক প্রচলন ইসলামী চিন্তাধারায় এক নতুন অধ্যায় সূচিত করেছে।”
— ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
ইসলামের মৌলিক আকিদা বা ইমানের স্তম্ভসমূহ
একজন মুসলিম মুমিন হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য নিচের সাতটি মৌলিক স্তম্ভে বিশ্বাস স্থাপন অপরিহার্য:
- আল্লাহর ওপর ঈমান
- ফেরেশতাগণের প্রতি ঈমান
- আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান
- রাসূলগণের প্রতি ঈমান
- পুনরুত্থান ও আখিরাতের প্রতি ঈমান
- কিয়ামত ও পরকালের প্রতি ঈমান
- তাকদীর বা আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্যের ওপর ঈমান
“সত্যপরায়ণ মুমিনগণ হলেন, যারা আল্লাহর প্রতি, ফেরেশতাগণের প্রতি, কিতাবসমূহ ও নবীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তা কঠোরভাবে মান্য করে।”
— সূরা বাকারা : ২৮৫
আকিদার গুরুত্ব ও প্রভাব
আকিদা একটি মুমিনের ব্যক্তিগত আত্মার প্রাণ। এটি জীবন পরিচালনার মূল ভিত্তি। আকিদা ছাড়া মুসলিম জীবন সম্পূর্ণ হয় না। এটি শুধু ধর্মীয় আনুগত্য নয়, বরং মানবজীবনের সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক নির্দেশনার কেন্দ্রবিন্দু।
“আকিদার মাধ্যমে একটি মুসলিম তার জীবন ও কর্মের ধারাকে আলোকিত করে এবং বিপদে-আপদে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে।”
— ইসলামী পন্ডিতগণ
একজন মানুষ যদি একাধিক মাবুদে বিশ্বাস স্থাপন করে তবে সে পথভ্রষ্ট। বরং আকিদার বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে মুমিন তার ঈমানকে পূর্ণতা দেয়।
আকিদার উৎস ও ভিত্তি
ইসলামি আকিদার মৌলিক উৎস হলো কোরআনুল কারীম ও সহিহ হাদিস। এই উৎসসমূহ থেকে যা যা বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে, সেগুলি নির্ভুলভাবে গ্রহণ ও মেনে চলা আবশ্যক। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে ইরশাদ করেছেনঃ
“তোমরা বিশ্বাস করো আল্লাহর ওপর, ফেরেশতাগণের ওপর, কিতাবসমূহের ওপর, নবীগণের ওপর এবং আখিরাতের দিন ও তাকদীরের ওপর।”
— সূরা নিসা : ১৩৬
বিশুদ্ধ আকিদা অর্জনের জন্য ইসলামী শিক্ষাবিদগণ প্রতিনিয়ত গবেষণা ও পাঠদান করে যাচ্ছেন। এটি মানব জীবনের সফলতা ও কল্যাণের এক অপরিহার্য চাবিকাঠি।
ঈমান ও আকিদার পার্থক্য
প্রায়ই আকিদা ও ঈমান একই হিসেবে গুলিয়ে ফেলা হয়, তবে বাস্তবে এগুলোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
- ঈমান : পূর্ণাঙ্গ দ্বীনকে অন্তর্ভুক্ত করে। মৌখিক স্বীকারোক্তি ও কর্মে প্রকাশ পায়।
- আকিদা : ধর্মবিশ্বাসের মূল ভিত্তি, দৃঢ়ভাবে অন্তরে ধারণ করা বিশ্বাস।
“আকিদা হলো ঈমানের ভিত্তি। আকিদা ছাড়া ঈমান অসম্পূর্ণ।”
— ইসলামী চিন্তাবিদগণ
উপসংহার
আকিদা হলো ইসলামের প্রাণ। এটি আমাদের অন্তরে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আমাদের জীবন পরিচালনার মূল দিশা নির্ধারণ করে। বিশুদ্ধ আকিদার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে একজন মুমিন ব্যক্তি তার জীবনকে আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত করে।
“ঈমান এই যে, তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহর প্রতি, ফেরেশতাগণের প্রতি, কিতাবসমূহে, নবীগণের প্রতি, আখিরাতের দিন এবং তাকদীরের ভালো-মন্দের ওপর।”
— সহিহ মুসলিম
আসুন আমরা সতর্ক হই, ইসলামের এই অমূল্য শিক্ষাকে হৃদয়গহ্বরে ধারণ করি এবং সকল বিপদে-আপদে আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করি। আল্লাহ তায়ালার রহমতে আমাদের জীবন শান্তিময় ও কল্যাণময় হয়ে উঠুক।
“বিশুদ্ধ আকিদা মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ও অপরিহার্য জ্ঞান।”
— ইসলামী পন্ডিতগণ
📚 আকীদা বিষয়ক বইসমূহ
আকীদা বিষয়ক বই ডাউনলোড করতে নিচে বইয়ের নামের উপর ক্লিক করুন।
১। অতি গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় প্রশ্নোত্তর — আব্দুর রহমান ইবন নাসীর
২। অত্যাবশ্যকীয় পাঠ সমূহ — আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায
৩। অধিকাংশ লোক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা সত্বেও মুশরিক — খলীলুর রহমান বিন ফযলুর রহমান
৪। অন্তর বিধ্বংসী বিষয় — মুহাম্মদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ
৫। অন্তরের রোগ — সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
৬। অন্ধ অনুসরণ — মোঃ মতিয়ার রহমান
৭। আকীকা এবং এ সংক্রান্ত কিছু বিধান — আলী হাসান তৈয়ব
৮। আকীদা ইসলামিয়াহ — মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব
৯। আকীদা সংক্রান্ত দশটি মাসআলা যা না জানলেই নয় — আবনাউত তাওহীদ
১০। আকীদাহ সম্পর্কিত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মাসআলাহ — মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী
১১। আকীদার কিছু অধ্যায় — আব্দুল আযীয ইবন মারযুক
১২। আকীদার মানদণ্ডে তাবীজ — আলী বিন নুফাই আল উলইয়ানী
১৩। আকীদাহ বিষয়ক দুইশতাধিক প্রশ্নোত্তর — হাফেয বিন আহমাদ আল হাকামী
১৪। আক্বীদা ওয়াসেত্বিয়া — আহমাদ বিন আব্দুল হালীম ইবনে তাইমিয়াহ
১৫। ইখলাস — আব্দুল্লাহ আল মামুন আল আযহারী
১৬। ইখলাস কেন ও কিভাবে — গবেষণা পরিষদ আল মুনতাদা আল ইসলামী
১৭। ইখলাস মুক্তির উপায় — ফায়সাল বিন আলি আল বাদানী
১৮। ইসলামী আকীদা — ইমাম গাযযালী রহঃ
১৯। ইসলামী আকীদা — ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
২০। ইসলামী আকীদা ও মানবপ্রকৃতি — ইকবাল হোছেন মাছুম
২১। ইসলামী আকীদা বিষয়ক কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মাসয়াল — মুহাম্মদ জামীল যাইনু
২২। ইসলামী আকীদাহ — মুহাম্মদ বিন জামীল যাইনু
২৩। ইসলামের মৌলিক আকীদা ও বিধান — ড. জামাল আল বাদাবী
২৪। ইসলামের মৌলিক নীতিমালা — মুহাম্মদ বিন সুলায়মান তামীমী
২৫। ইসলামের মৌলিক বিষয় এবং গুরুত্বপূর্ণ হাদীস নির্ণয়ের সহজতম উপায় — মোঃ মতিয়ার রহমান
২৬। একগুচ্ছা মুক্তাদানাঃ দ্বীনে ইসলামীর সৌন্দর্য — আবদুর রহমান ইবন নাসের ইবন সাদী
২৭। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাক্বলীদ — শরীফুল ইসলাম বিন যয়নুল আবেদীন
২৮। কুরআন ও হাদীসের আলোকে ইসলামী আকীদা — এ এন এম সিরাজুল ইসলাম
২৯। কুরআন হাদীসের আলোকে সহজ আকীদা — ড.আহমাদ ইবন আব্দুর রহমান আল কাযী
৩০। কুরআন-সুন্নাহর আলকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা — সালেহ আল উসাইমিন
৩১। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা — ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
৩২। প্রশ্নোত্তরে আকীদার মানদণ্ডে মুসলিম — মুহাম্মদ নাজমুল বিন আমানত
৩৩। প্রশ্নোত্তরে ইসলামি আকীদা — আ. ন. ম. রশিদ আহমাদ
৩৪। মৃত্যুর সময় ও কারণ পূর্ব নির্ধারিত তথ্যটির প্রচলিত ও প্রকৃত ব্যাখ্যা — ডাঃ মোঃ মতিয়ার রহমান
৩৫। সঠিক আকীদা বিশ্বাস ও যা এর পরিপন্থী — আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায