
✍️ স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী | জাতীয়তাবাদী নেতা | মানবতাবাদী চিন্তাবিদ
প্রস্তাবনা
পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু (১৪ নভেম্বর ১৮৮৯ – ২৭ মে ১৯৬৪) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
তিনি ছিলেন একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক, চিন্তাবিদ ও লেখক, যিনি আধুনিক ভারতের ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর নেতৃত্বে ভারত গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয়।
“জীবনের প্রকৃত শিক্ষা আসে বই থেকে নয়, অভিজ্ঞতা থেকে।” – জওহরলাল নেহেরু
প্রারম্ভিক জীবন
১৮৮৯ সালের ১৪ নভেম্বর উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে এক সমৃদ্ধ কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নেহেরু। তাঁর পিতা মতিলাল নেহেরু ছিলেন একজন প্রখ্যাত আইনজীবী ও জাতীয়তাবাদী নেতা এবং মাতা স্বরূপারানী নেহেরু ছিলেন শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা নারী।
শৈশব থেকেই নেহেরু ছিলেন অনুসন্ধিৎসু, প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এবং প্রকৃতিপ্রেমী। পরবর্তীকালে তাঁর জন্মদিন (১৪ নভেম্বর) ভারতে শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়।
শিক্ষাজীবন
নেহেরুর শিক্ষাজীবন ছিল আন্তর্জাতিক মানের। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন ইংরেজ টিউটরের কাছে।
১৯০৫ সালে তিনি ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন এবং বিখ্যাত হ্যারো স্কুল, ট্রিনিটি কলেজ (কেমব্রিজ) ও লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ সাত বছর অধ্যয়ন করেন।
বিজ্ঞান ও দর্শনের পাশাপাশি ইতিহাস ও রাজনীতিতেও ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ।
১৯১২ সালে তিনি ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফিরে আসেন এবং এলাহাবাদ হাইকোর্টে আইন পেশা শুরু করেন।
বিবাহ ও পরিবার
দেশে ফিরে কিছুদিন আইনচর্চা করার পর দিল্লির বিশিষ্ট পরিবারে জন্ম নেওয়া কমলা নেহেরু-র সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।
১৯১৭ সালে তাঁদের কন্যা ইন্দিরা নেহেরু (পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধী) জন্মগ্রহণ করেন, যিনি পরবর্তীতে ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হন।
“পরিবার একজন মানুষের চরিত্র গঠনের প্রথম বিদ্যালয়।” – নেহেরু
রাজনৈতিক জীবন
দেশে ফিরে তিনি প্রথমদিকে পাশ্চাত্য ভাবধারায় প্রভাবিত ছিলেন, কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে, যা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
১৯১৭ সালে অ্যানি বেসান্তের অন্তরীণ হওয়ার প্রতিবাদে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
১৯২০ সালে তিনি এলাহাবাদ কংগ্রেস কমিটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ক্রমে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯২৯ সালের লাহোর কংগ্রেস অধিবেশনে তিনি কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সেখানেই “পূর্ণ স্বরাজ” (সম্পূর্ণ স্বাধীনতা)-এর লক্ষ্য ঘোষণা করেন।
১৯৩০ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে তিনি প্রায় নয়বার কারাবাস করেন। কারাগারে বসেই তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “An Autobiography”।
“আমার জন্য কারাগার মানে শিক্ষা ও আত্মজিজ্ঞাসার এক নীরব আশ্রম।” – নেহেরু
স্বাধীন ভারতের নেতৃত্ব
১৯৪৬ সালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
তাঁর শাসনামলে ভারত পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয়।
তিনি গঠন করেন পরিকল্পনা কমিশন এবং ভারতের জন্য গ্রহণ করেন পাঁচ বছর মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা।
তাঁর নীতি ছিল – বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশের আত্মনির্ভরতা অর্জন। বৈদেশিক নীতিতেও নেহেরু ছিলেন স্বতন্ত্র চিন্তার অধিকারী।
তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (Non-Aligned Movement), যেখানে মিশরের নাসের ও যুগোস্লাভিয়ার টিটোর সঙ্গে যৌথ নেতৃত্ব দেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন, ভারতকে কোনও পরাশক্তির অনুসারী নয়, বরং শান্তি ও মানবতার পক্ষের নেতৃত্ব দিতে হবে।
রচনাবলী
নেহেরু ছিলেন গভীর চিন্তাশীল ও সাহিত্যপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যেও রেখেছেন অমর দাগ।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ:
- Letters from a Father to His Daughter – কন্যা ইন্দিরার উদ্দেশে লেখা শিক্ষণীয় পত্রসমূহ।
- Glimpses of World History – বিশ্ব ইতিহাসের বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থ।
- An Autobiography – আত্মজীবনীমূলক অনন্য রচনা।
- The Discovery of India – ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জাতীয় চেতনা নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ।
এই রচনাগুলোর মধ্য দিয়ে নেহেরুর দার্শনিক ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে।
চিন্তাধারা
নেহেরুর চিন্তাধারা ছিল আধুনিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও মানবকল্যাণে নিবেদিত।
তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা ও বিজ্ঞানই জাতির মুক্তির প্রধান উপায়।
তাঁর আদর্শ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক উন্নয়ন।
তিনি সর্বদা তরুণ প্রজন্মকে আহ্বান জানিয়েছিলেন – “দেশকে ভালোবাসো, জ্ঞান অর্জন করো এবং মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করো।”
প্রভাব ও উত্তরাধিকার
নেহেরুর অবদান ভারতের ইতিহাসে অনস্বীকার্য।
তিনি শুধু একজন রাজনীতিক নন, বরং আধুনিক ভারতের স্থপতি।
তাঁর পরিকল্পিত অর্থনীতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ (যেমন IIT, AIIMS, ISRO-এর ভিত্তি) এবং বৈদেশিক নীতি আজও ভারতের পথপ্রদর্শক।
“আজকের ভারত যদি আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক চেতনার দেশ হয়, তবে তার সূচনা হয়েছিল নেহেরুর স্বপ্নে।”
মৃত্যু
১৯৬৪ সালের ২৭ মে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নেহেরু পরলোকগমন করেন।
তাঁর মৃত্যু ভারতবর্ষের জন্য ছিল এক যুগের অবসান।
তবু তাঁর ভাবনা, রচনা ও স্বপ্ন আজও ভারতের রাষ্ট্রচিন্তায় অমর হয়ে আছে।
উপসংহার
পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা ও আধুনিকতার মধ্যবর্তী সেতুবন্ধন।
তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে রাজনৈতিক আদর্শ, মানবতা ও যুক্তিবাদ একত্রে জাতিকে এগিয়ে নিতে পারে।
তাঁর জীবন, রচনা ও দৃষ্টিভঙ্গি আজও নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।
আরও পড়ুন
👉 Nehru Centre
👉 Official Biography – Government of India
পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু কর্তৃক রচিত pdf বই ডাউনলোড করতে নিচের বইয়ের নামের উপর ক্লিক করুন।
১। আত্মচরিত
২। কিশোর ইন্দীরা গান্ধীকে লেখা পন্ডিত জহরলাল নেহরুর চিঠি
৩। দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া
৪। বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গে
৫। ভারত সন্ধানে