ইউসূফ আল কারযাভী: Yusuf al-Qaradawi Books

ইউসূফ আল কারযাভী
Yusuf al-Qaradawi Books

শায়খ ড. ইউসুফ আল কারজাভি : জীবন, কর্ম ও প্রভাব

প্রস্তাবনা

ইসলামী জ্ঞানের ভাণ্ডারে কিছু ব্যক্তিত্ব এমন আছেন, যাদের অবদান শুধু একটি প্রজন্মকেই নয় বরং যুগের পর যুগ মানবসমাজকে প্রভাবিত করে।
শায়খ ড. ইউসুফ আল কারজাভি (১৯২৬–২০২২) ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। তিনি ছিলেন ইসলামী চিন্তার নবজাগরণের অগ্রদূত, একজন প্রাজ্ঞ আলিম,
নির্ভীক দাঈ, সমাজ সংস্কারক, ইসলামী অর্থনীতির পথিকৃৎ এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য আধুনিক যুগের অন্যতম কণ্ঠস্বর।

“ড. কারজাভি ছিলেন এমন এক আলিম, যিনি সমসাময়িক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জকে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সমাধান করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।”

প্রারম্ভিক জীবন

শায়খ ইউসুফ আল কারজাভি ১৯২৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মিসরের উত্তরাঞ্চলের গরিব কিন্তু ধর্মপ্রাণ একটি গ্রাম—সাফাত তোরাবে জন্মগ্রহণ করেন।
দুই বছর বয়সে পিতার মৃত্যু হলে তার লালনপালনের দায়িত্ব চাচার ওপর এসে পড়ে।
দারিদ্র্য ও কষ্টের মধ্যেও শৈশব থেকে তিনি আল্লাহভীতি ও ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি একাগ্র ছিলেন।

শিক্ষাজীবন

মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি কুরআনে কারিম হিফজ সম্পন্ন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়-এর কারিকুলামে
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন এবং মেধা তালিকায় শীর্ষস্থান অর্জন করেন। তিনি উসূলুদ্দীন অনুষদ থেকে অনার্স,
আরবি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা এবং ইসলামী শরীয়াহ্‌তে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

“শিক্ষা শুধু জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়; বরং তা দাওয়াত, সংস্কার ও নেতৃত্বের ভিত্তি।” – ড. কারজাভি

কর্মজীবন

কর্মজীবন শুরু হয় মিসরের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন Institute of Imams-এর পরিদর্শক হিসেবে। কিছু সময় কাজ করেন আওকাফ মন্ত্রণালয়ের
Board of Religious Affairs-এ। ১৯৭৭ সালে তিনি কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে শরীয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের
প্রতিষ্ঠাকালীন ডিন নিযুক্ত হন এবং ১৯৯০ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এখানেই তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়
সীরাত ও সুন্নাহ গবেষণা কেন্দ্র

আন্তর্জাতিক দায়িত্ব

  • ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলার্সের চেয়ারম্যান (২০০৪ পর্যন্ত)
  • ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফাতওয়া অ্যান্ড রিসার্চের প্রধান
  • OIC ও রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামীর সদস্য
  • অক্সফোর্ড ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টারের সম্মানিত সদস্য

চিন্তাধারা ও অবদান

শায়খ কারজাভির চিন্তাধারা মূলত ছিল কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক। তিনি ইসলামে ওয়াসাতিয়াহ বা মধ্যপন্থার ধারণা
প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আধুনিক বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে মুসলিম সমাজের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তিনি
মধ্যপন্থী, ভারসাম্যপূর্ণ ও যুক্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেন।

“ইসলামের সৌন্দর্য তার ভারসাম্যে—না অতিরিক্ত কঠোরতায়, না অতিরিক্ত শিথিলতায়।” – ড. ইউসুফ আল কারজাভি

কারাবরণ ও দেশত্যাগ

ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে বারবার তাকে কারাগারে যেতে হয়। ১৯৪৯ সালে প্রথমবার,
এবং প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসেরের আমলে আরও তিনবার তিনি কারাবরণ করেন। সর্বশেষ ১৯৬৩ সালে তিনি গ্রেফতার হন।
১৯৬১ সালে তিনি কাতারে প্রথম পাড়ি জমান এবং পরবর্তী জীবনের বড় অংশ কাটান সেখানেই।
২০১৫ সালে মিসরের একটি আদালত তার অনুপস্থিতিতেই মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়।

রচনাবলী

ড. কারজাভির রচিত বইয়ের সংখ্যা একশোরও বেশি। তার রচনায় সমসাময়িক সমস্যা, ইসলামী অর্থনীতি, ফিকহ,
দাওয়াহ, তরুণ প্রজন্মের শিক্ষা, নারীর অধিকার, রাজনীতি ও সামাজিক সংস্কারের বিষয়বস্তু প্রাধান্য পেয়েছে।
তার উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো:

  • আল-হালাল ওয়াল হারাম ফীল ইসলাম
  • ফিকহুয যাকাত (২ খন্ড)
  • আওলাউইয়াতুল হারাকাতিল ইসলামিয়্যাহ
  • আস-সাহওয়া আল-ইসলামিয়্যাহ বাইনাল জুহুদ ওয়াত-তাত্বাররুফ
  • কাইফা নাতা’আমালু মা’আস সুন্নাহ
  • ফিকহুল জিহাদ
  • আল-ইসলামু ওয়াল ফান্ন
  • ফাতাওয়া মু’আসারাহ

বাংলায় অনূদিত গ্রন্থসমূহ

  • সুন্নাহর সান্নিধ্যে
  • ইসলামে হালাল হারামের বিধান
  • ইসলামে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা
  • ইসলামে দারিদ্র বিমোচন
  • ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা: তত্ত্ব ও প্রয়োগ

পুরস্কার ও সম্মাননা

ড. কারজাভি তার জীবনে বহু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন।

  • কিং ফয়সাল ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ
  • আন্তর্জাতিক পবিত্র কুরআন সম্মাননা, দুবাই
  • সুলতান হাসান আল বলকিয়াহ সম্মাননা, ব্রুনাই
  • মালয়েশিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পদক
  • আল-ওয়াইস পদক, সংযুক্ত আরব আমিরাত

প্রভাব

শায়খ ইউসুফ আল কারজাভি ছিলেন সমকালীন ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম চিন্তানেতা। তার ওয়াসাতিয়াহর ধারণা
মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এক নতুন বোধ তৈরি করে। তিনি ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের অন্যতম আদর্শিক ব্যক্তিত্ব,
তবে সবসময় জোর দিয়েছেন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ও সংস্কারের ওপর।

ইন্তেকাল

২০২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর (২৯ সফর ১৪৪৪ হিজরি) কাতারের রাজধানী দোহায় তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।
তার মৃত্যু বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

“তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তার চিন্তাধারা, বই ও দাওয়াহ মুসলিম উম্মাহকে আগামী প্রজন্মেও দিকনির্দেশনা দেবে।”

উপসংহার

শায়খ ড. ইউসুফ আল কারজাভি ছিলেন এক আলোকবর্তিকা, যিনি আধুনিক বিশ্বে ইসলামের আলোকে সমাধান খুঁজতে
আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। তার জীবন সংগ্রাম, দাওয়াহ, গবেষণা ও রচনাবলী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়,
একজন সৎ আলিম কেবল জ্ঞানার্জনেই সীমাবদ্ধ থাকেন না; বরং তিনি সমাজকে পরিবর্তনের জন্য লড়াই করেন।

আরও পড়ুন

👉 ইসলামী বই
👉 ইসলামি উপন্যাস


error: Content is protected !!
Scroll to Top