শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ: জীবন, কর্ম ও অবদান
✍️ প্রখ্যাত মুহাদ্দিস | লেখক | বক্তা | দাওয়াতি আন্দোলনের অগ্রদূত
প্রস্তাবনা
শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ বাংলাদেশের সমসাময়িক ইসলামি অঙ্গনের এক সুপরিচিত নাম। তিনি একজন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, দাঈ এবং লেখক। তাঁর বক্তব্যের বৈশিষ্ট্য হলো আরবি হাদিসের ইবারাত মুখস্থ পাঠ করা এবং সরাসরি অনুবাদ করা। বাংলা ভাষাভাষী শ্রোতাদের মাঝে তিনি হাদিস ও তাফসীরভিত্তিক বক্তব্যের জন্য বিশেষভাবে সমাদৃত। তাঁর কলম থেকে প্রকাশিত বহু গ্রন্থ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব ও আন্তর্জাতিক দাওয়াহ কার্যক্রম তাঁকে একজন অনন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।
“আমার প্রতিটি বক্তব্য একেকটি দারসে হাদিস। আমি চাই মানুষ সরাসরি কুরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে জীবন গড়ুক।” – শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ
প্রারম্ভিক জীবন
শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ বাংলাদেশের চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার দেবীনগর উপজেলার মাওলা বক্স হাজীরটলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর থেকেই তিনি একটি ধার্মিক পরিবারে বেড়ে ওঠেন। তাঁর পরিবার ইসলামি শিক্ষায় অনুরাগী ও ধর্মনিষ্ঠ ছিল, যা তাঁর জীবন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠার ফলে কুরআন-হাদিসের প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন।
শিক্ষাজীবন
শিক্ষাজীবনের শুরু হয় এলাকার স্থানীয় মক্তবে। এরপর তিনি নাচল নবাবগঞ্জ মাদরাসায় ভর্তি হন এবং সেখানে হাদিসের গুরুত্বপূর্ণ কিতাব মিশকাত শরীফ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি ভারত যান এবং উত্তর প্রদেশের বিখ্যাত দারুল উলুম থেকে দাওরা হাদিস সম্পন্ন করেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তিনি দুইবার দাওরা হাদিস সমাপ্ত করেন, যা তাঁর জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ও নিষ্ঠার প্রমাণ বহন করে।
দেশে ফিরে তিনি ফাজিল ও কামিল পরীক্ষায় অংশ নেন এবং হাদিস ও তাফসীর নিয়ে প্রথম বিভাগে কামিল পাশ করেন। এর ফলে তিনি একজন সুদক্ষ মুহাদ্দিস ও আলেম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
“জ্ঞান অর্জনের জন্য আমি সীমান্ত পেরিয়েছি, কষ্ট স্বীকার করেছি। কারণ, রাসূল (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের পথে বের হয়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।’”
কর্মজীবন
শিক্ষা সমাপ্তির পর শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। প্রথমে তিনি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে অবস্থিত আল মারাকাজুল ইসলামী মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি রাজশাহীর আল মারকাজুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া-তে একজন মুহাদ্দিস হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রায় পাঁচ বছর তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ছিলেন এবং তাঁর নেতৃত্বে মাদরাসাটি শিক্ষাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করে।
এছাড়া তিনি *মাসিক আত তাহরিক* পত্রিকার ফতোয়া বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি তিনি আল জামিয়াতুস সালাফিয়া নামক একটি প্রতিষ্ঠানও পরিচালনা করছেন, যা ইসলামি শিক্ষার প্রসারে অবদান রাখছে।
দ্বীনের খিদমাত
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বক্তব্য দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। মাদরাসার দারসে হাদিস দানের পাশাপাশি তিনি মসজিদ, মাদরাসা ও বিভিন্ন ইসলামী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে থাকেন। বর্তমানে তিনি বাংলা ভাষাভাষী আলেমদের মাঝে একজন সুপরিচিত বক্তা। তাঁর বক্তব্যে মূলত হাদিসের পাঠ, অনুবাদ ও ব্যাখ্যা স্থান পায়। ফলে প্রতিটি বক্তব্যই হয়ে ওঠে দারসে হাদিস।
তিনি নিয়মিত পিস টিভি-তে লেকচার প্রদান করেছেন, যা তাঁকে আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিতি এনে দেয়। সৌদি আরব, দুবাই, ভারত ও মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন।
“দাওয়াত মানে কেবল বক্তৃতা নয়, বরং মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর কালাম পৌঁছে দেওয়া।” – শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ
বক্তব্যের বৈশিষ্ট্য
তাঁর বক্তব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো হাদিসের আরবী ইবারাত মুখস্থ পাঠ করা এবং সরাসরি বাংলা অনুবাদ করা। প্রায় দুই-আড়াই হাজার হাদিস তিনি মুখস্থ করেছেন। একেকটি বিষয়ের ওপর তিনি দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত বক্তব্য রাখতে পারেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্যে কেবল হাদিস ও তার ব্যাখ্যাই স্থান পায়।
রচনাবলী
শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ একজন উর্বর লেখক। তাঁর বইগুলোতে কুরআন ও হাদিসের আলোকে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে।
প্রসিদ্ধ গ্রন্থাবলি
- আদর্শ নারী
- আদর্শ পুরুষ
- আইনে রাসূল (ছাঃ) দো’আ অধ্যায়
- আদর্শ পরিবার
- কে বড় ক্ষতিগ্রস্ত?
- রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত বনাম প্রচলিত ছালাত
- মরণ একদিন আসবেই
- উপদেশ
- কে বড় লাভবান?
- তাফসীর কি মিথ্যা হতে পারে?
- বক্তা ও শ্রোতার পরিচয়
- পোশাক
- তাওযীহুল কুরআন (২৮তম, ২৯তম, ৩০তম পারা)
“আমার বইগুলো কেবল পাঠ্য নয়, বরং মানুষের জীবনের দিশারী।” – শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ
চিন্তাধারা
তাঁর চিন্তাধারার মূল ভিত্তি হলো কুরআন ও সহীহ হাদিস। তিনি সর্বদা প্রচলিত কুসংস্কার ও বিদআত থেকে মুক্ত থেকে ইসলামের মূল শিক্ষায় ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর দৃষ্টিতে ইসলামী সমাজ গড়ার মূল উপাদান হলো ঈমান, ইলম, আমল ও তাকওয়া।
তিনি মুসলিম সমাজের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য শিক্ষা সংস্কার, পারিবারিক জীবন ইসলামের আলোকে গড়ে তোলা এবং দাওয়াতের কাজে গুরুত্ব দেওয়ার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন।
প্রভাব
বাংলাদেশে সহীহ হাদীসভিত্তিক দাওয়াতি কাজে শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বক্তব্য ও গ্রন্থ পাঠকদের মাঝে গভীর প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম তাঁর বক্তৃতা ও বই থেকে অনুপ্রাণিত হচ্ছে।
তিনি একদিকে যেমন আলেম সমাজে মর্যাদাপূর্ণ স্থান অর্জন করেছেন, তেমনি সাধারণ মানুষকেও ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করেছেন। তাঁর দাওয়াত আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রসারিত হয়েছে।
উপসংহার
শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ কেবল একজন মুহাদ্দিস নন, তিনি একজন শিক্ষাবিদ, লেখক ও দাঈ। তাঁর জীবন ও কর্ম মুসলিম সমাজে সহীহ ইসলাম প্রচারের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ইসলামের বিশুদ্ধ জ্ঞান প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর যে অবদান, তা ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে।
আরও পড়ুন
👉 খ শিরোনামের বই
👉 মুহম্মাদ আব্দুর রহমান আল আরিফী
📚 আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ এর বইসমূহ
আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফের pdf বই ডাউনলোড করতে নিচে বইয়ের নামের উপর ক্লিক করুন।
১। আইনে রাসুল সাঃ দোআ অধ্যায়
২। আদর্শ নারী
৩। আদর্শ পরিবার
৪। আদর্শ পুরুষ
৫। উপদেশ
৬। কে বড় ক্ষতিগ্রস্ত
৭। কে বড় লাভবান
৮। তাওযীহুল কুরআন
৯। তাফসীর কি মিথ্যা হতে পারে
১০। বক্তা ও শ্রোতার পরিচয়
১১। মরণ একদিন আসবেই