✍️ বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ | আহলে হাদিস আন্দোলনের নেতা | লেখক ও সম্পাদক
প্রস্তাবনা
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ-হিল কাফি (১৯০০–১৯৬০) ছিলেন উপমহাদেশের এক প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ, আহলে হাদিস আন্দোলনের অগ্রগামী নেতা, রাজনীতিক ও সাহিত্যিক।
তিনি তাঁর প্রজ্ঞা, লেখনী এবং সাংগঠনিক দক্ষতার মাধ্যমে বাংলার ইসলামি সমাজে নবজাগরণের সঞ্চার ঘটিয়েছিলেন।
রাজনীতি থেকে শুরু করে শিক্ষা, সমাজ সংস্কার ও দাওয়াহ কার্যক্রম—সব ক্ষেত্রেই তিনি রেখেছেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
“যে জাতি ইসলামের মূলনীতি থেকে বিচ্যুত হয়, সে জাতি কখনো প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে না।” – মুহাম্মদ আবদুল্লাহ-হিল কাফি
প্রারম্ভিক জীবন
১৯০০ সালে ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বর্ধমান জেলার টুবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ আবদুল্লাহ-হিল কাফি।
তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল দিনাজপুর জেলার বস্তিয়াড়া গ্রামে।
পিতা সৈয়দ আবদুল হাদি ছিলেন এক ধার্মিক ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি, যিনি ছেলেকে শৈশব থেকেই জ্ঞানচর্চায় উৎসাহিত করতেন।
মায়ের কাছ থেকে তিনি উর্দু ও ফারসি ভাষা শিখেন, আর পিতার কাছ থেকে আরবি ও প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন।
শিক্ষাজীবন
বাড়িতেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করে ১৯০৬ সালে তিনি স্থানীয় নূরুল হুদা মাদ্রাসায় ভর্তি হন।
১৯০৯ সাল পর্যন্ত সেখানে অধ্যয়ন শেষে রংপুরের কৈলাসরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে হুগলি জেলা স্কুলে স্থানান্তরিত হন।
১৯১৭ সালে কলকাতা মাদ্রাসা থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন।
এরপর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯১৯ সালে আইএ সম্পন্ন করেন।
বিএ শ্রেণীতে পড়ার সময় অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রভাবে তিনি ইংরেজি শিক্ষা ত্যাগ করেন এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত হন।
“শিক্ষা কেবল জ্ঞানের বাহন নয়, এটি আদর্শ ও আত্মত্যাগের চেতনা জাগায়।” – কাফি
রাজনৈতিক জীবন
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ-হিল কাফির রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে।
তিনি সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৯২২ সালে জমিয়তে উলামায়ে বাঙ্গালা-এর সহকারী সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯২৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টি-তে যোগ দেন এবং দলের সেক্রেটারি ও নির্বাচন বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করেন।
১৯৩০ সালে মুসলিম ন্যাশনাল পার্টি-র নেতা হিসেবে দিনাজপুরে আইন অমান্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন, যার ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
দুই বছর কারাভোগের পর তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে ইসলামি সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন।
ইসলামি কর্মকাণ্ড
রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পর কাফি ইসলামি দাওয়াহ ও সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৩৫ সালে রংপুরের হারাগাছা বন্দরে অনুষ্ঠিত উত্তরবঙ্গ আহলে হাদিস সম্মেলন-এ তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
পরবর্তীতে ১৯৪০ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত জাতীয়তাবাদী মুসলিম সম্মেলন-এ বাংলার প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন।
১৯৪৪ ও ১৯৪৫ সালের নিখিল ভারত আহলে হাদিস সম্মেলনেও তিনি বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেন।
১৯৪৬ সালে তিনি নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমিয়তে আহলে হাদিস-এর সভাপতি নির্বাচিত হন এবং আন্দোলনকে তৃণমূল পর্যায়ে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কাজ করেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে আহলে হাদিস রাখা হয় এবং সদরদপ্তর কলকাতা থেকে পাবনায় স্থানান্তরিত হয়।
তিনি পাকিস্তানে ইসলামি সংবিধান প্রণয়নের দাবিতে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন।
সম্পাদকীয় ও সাংবাদিকতা
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ-হিল কাফি ছিলেন একজন দক্ষ সম্পাদক ও লেখক।
১৯২১ সালে তিনি উর্দু দৈনিক “জামানা”-র সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
১৯২৪ সালে প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক “সত্যাগ্রহী” পত্রিকা, যা মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে তিনি সাপ্তাহিক “আরাফাত” এবং ১৯৪৯ সালে মাসিক “তর্জমানুল হাদিস” পত্রিকা প্রকাশ করেন, যা আহলে হাদিস চিন্তাধারার প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
“কলমই সমাজ পরিবর্তনের সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার।” – আবদুল্লাহ-হিল কাফি
রচনাবলী
লেখালেখি ও গবেষণায় তাঁর আগ্রহ ছিল গভীর।
তিনি মোট ২৬টি গ্রন্থ রচনা করেন, যেখানে ইসলামি শাসনব্যবস্থা, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও তাওহিদের ব্যাখ্যা উঠে এসেছে।
প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহ
- ইসলামী শাসনতন্ত্রের সূত্র
- নবুওতে মোহাম্মদী
- আহলে হাদিস পরিচিতি
- আল-ইসলাম ও কমিউনিজম
- ধন বণ্টনের রকমারি ফর্মুলা
তাঁর লেখাগুলোতে ছিল বাস্তবধর্মী চিন্তা, যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণ এবং ইসলামি সমাজ গঠনের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা।
প্রভাব ও উত্তরাধিকার
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ-হিল কাফি ছিলেন এমন এক চিন্তাবিদ, যিনি রাজনীতি ও ধর্মীয় নেতৃত্বকে সমন্বয় করেছেন।
তাঁর নেতৃত্বে আহলে হাদিস আন্দোলন বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
তিনি মুসলমানদের আত্মপরিচয়, ঐক্য ও শুদ্ধ আকিদার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক।
মৃত্যু
১৯৬০ সালে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর মৃত্যু আহলে হাদিস আন্দোলন ও ইসলামি সমাজচিন্তায় এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করে।
তবুও তাঁর আদর্শ, লেখনী ও দাওয়াহ কার্যক্রম আজও নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
“একজন আলেমের প্রকৃত জীবন শেষ হয় না; তার চিন্তা ও কলম প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বেঁচে থাকে।”
উপসংহার
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ-হিল কাফি ছিলেন এমন এক প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব, যিনি শিক্ষা, রাজনীতি ও ইসলামি দাওয়াহকে একত্রিত করেছিলেন।
তিনি প্রমাণ করেছেন যে, ইসলামী মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়িত্ব একসঙ্গে চলতে পারে।
তাঁর জীবন ও কর্ম আজও মুসলমানদের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ এবং তাঁর রচনাবলী ইসলামি চিন্তার ভাণ্ডারে এক অমূল্য সংযোজন।
আরও পড়ুন
👉 আহলে হাদিস মিশন
👉 ইসলামিক বই সমাহার
মুহাম্মদ আব্দুল্লাহহেল কাফী কর্তৃক রচিত ইসলামিক pdf বই ডাউনলোড করতে নিচে নামের উপর ক্লিক করুন।
১। আল ইসলাম বনাম কমিউনিজম
২। আল্লামা মুহাম্মদ নাসিরুদ্দিন আলিবানী এর জীবনী
৩। একটি পত্রের জবাব
৪। কালেমা ত্যাইয়েবা
৫। তিন তালাক প্রসঙ্গ
৬। নবুয়াতি মুহাম্মাদী
৭। ফিরকাবন্দি বনাম অনুসরণীয় ইমামগণের নীতি
ধন্যবাদ