
ড. আসাদুল্লাহ আল গালিব (হাফিযাহুল্লাহু তা’আলা) – জীবন, কর্ম ও অবদান
✍️ প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক ও লেখক
প্রস্তাবনা
বাংলাদেশে ইসলামী চিন্তাধারার উন্নয়ন ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে
ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব (হাফিযাহুল্লাহু তা’আলা)
অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তিনি কেবল একজন ধর্মীয় আলেম নন, বরং একজন সমাজ সংস্কারক,
দার্শনিক এবং গবেষক হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের শেখায় কিভাবে ইসলামের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি
সমাজে রূপান্তর ঘটাতে পারে। তার দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিকতা ও ঐতিহ্যকে সমন্বয় করে একটি সমৃদ্ধ ও নৈতিক
সমাজ প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।
“মানবজাতি তখনই মুক্তি পায় যখন সে মানবসৃষ্ট সব মতবাদ পরিত্যাগ করে একমাত্র অহির বিধানের প্রতি আত্মসমর্পণ করে।” – ড. আসাদুল্লাহ আল গালিব
প্রারম্ভিক জীবন
ড. আসাদুল্লাহ আল গালিব ১৯৪৮ সালের ১৫ জানুয়ারি সাতক্ষীরা সদর থানার বুলারাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পিতা, মাওলানা আহমাদ আলী (১৮৮৩-১৯৭৬), দক্ষিণাঞ্চলের একজন খ্যাতনামা আহলেহাদীছ আলেম ছিলেন।
পরিবারের প্রথাগত ধারার প্রতি অঙ্গীভূত থাকলেও, তিনি শিশু বয়স থেকে ইসলামী শিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন।
বড় ভাই আব্দুল্লাহিল বাকী ছিলেন মুসলিম লীগের বিশিষ্ট নেতা, যিনি দেশ বিভাগের সময় পাকিস্তান আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এই পরিবেশে বড় হওয়ায় গালিব সাহেবের চিন্তাভাবনায় সামাজিক দায়িত্ব ও নৈতিকতা প্রাথমিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়।
তাঁর বংশপরিক্রমা ছিল অনন্য—সৈয়দ নাযীর আলী আল-মাগরেবী (রহ.) ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে মরক্কো থেকে এদেশে আগমন করেছিলেন।
এই ঐতিহ্যগত ও দার্শনিক প্রেক্ষাপট গালিব সাহেবের চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
তিনি একক নয়, বরং চার সন্তানের জনক এবং পরিবারে শিক্ষিত ও ধর্মনিষ্ঠ পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন।
শিক্ষাজীবন
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা তিনি সাতক্ষীরার কাকডাঙ্গা সিনিয়র মাদরাসা থেকে সম্পন্ন করেন।
সেখানে দাখিল, আলিম ও ফাযিল স্তরে শীর্ষস্থানীয় ছিলেন। পরবর্তীতে জামালপুরের আরামনগর কামিল মাদরাসা থেকে
১৯৬৯ সালে কামিল পরীক্ষা কৃতিত্বের সাথে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন।
পূর্ব পাকিস্তান মাদরাসা বোর্ডে আলিম ও কামিল পরীক্ষায় যথাক্রমে ১৬তম এবং ৫ম স্থান অর্জন তাঁর প্রাথমিক শিক্ষায় অসামান্য কৃতিত্ব প্রমাণ করে।
উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলারোয়া সরকারী কলেজ, সাতক্ষীরা থেকে আইএ এবং খুলনার সরকারী মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ থেকে বিএ সম্পন্ন করেন।
১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবী বিভাগে মাস্টার্স সম্পন্ন করে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন।
১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডে পিএইচডি গবেষণার জন্য কমনওয়েলথ স্কলারশিপ লাভ করেন, যদিও শেষ পর্যন্ত গমন করেননি।
অবশেষে ১৯৯২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
মাতৃভাষা বাংলাসহ আরবী, ইংরেজি, উর্দু ও ফার্সীতে তিনি দক্ষতা অর্জন করেন।
“শিক্ষা কেবল জ্ঞান অর্জন নয়; এটি ব্যক্তিত্ব ও সমাজ গঠনের অন্যতম মূলমন্ত্র।” – ড. আসাদুল্লাহ আল গালিব
কর্মজীবন
১৯৮০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনিস্টিটিউট অব মডার্ন ল্যাংগুয়েজে খণ্ডকালীন লেকচারার হিসেবে যোগ দেন।
একই বছরের ১০ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামী শিক্ষা বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন।
২০১৬ সালে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কর্মজীবনের সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ এবং ভারত,
পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, সৌদি আরব, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভ্রমণ করেছেন।
২০০০ সালে সৌদি সরকারের রাজকীয় মেহমান হিসেবে হজ্জব্রত পালন করেন।
“একজন আলেমের কাজ শুধুই শিক্ষা দেওয়া নয়, বরং সমাজের নৈতিক ও ধর্মীয় জাগরণ ঘটানো।” – ড. আসাদুল্লাহ আল গালিব
ইলমী খেদমত
তিনি ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও সাহিত্য ক্ষেত্রে নিয়মিত লেখালেখি করেছেন।
মাসিক আত-তাহরীক পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা ছাড়াও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রিকায় তার প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ৫ শতাধিক।
এমফিল ও পিএইচডি গবেষণার তত্ত্বাবধান, জার্নাল সম্পাদনা ও একাডেমিক গবেষণার দায়িত্ব পালনও করেছেন।
ইতিমধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রন্থ ও পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে।
রচনাবলী
- বঙ্গানুবাদ কুরআন ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর
- তাফসীরুল কুরআন – ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০ তম পারা
- ছালাতুর রাসূল
- জিহাদ ও ক্বিতাল
- শবেবরাত, হজ্জ ও ওমরা
- আক্বীদা ইসলামিয়াহ, হাদীছের প্রামাণিকতা
- মাসায়েলে কুরবানী ও আক্বীকা, তালাক ও তাহলীল
- আহলেহাদীছ আন্দোলন: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন?
- জীবন দর্শন, ইনসানে কামেল, নৈতিক ভিত্তি ও প্রস্তাবনা
- দাওয়াত ও জিহাদ, মানবিক মূল্যবোধ, সমাজ পরিবর্তনের স্থায়ী কর্মসূচী
- ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ
- নবীদের কাহিনী (১-৩), সীরাতুর রাসূল (ছা.)
অনুবাদ ও সম্পাদনাতেও তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য।
চিন্তাধারা ও সমাজ সংস্কার
৫০ ও ৬০-এর দশকে আহলেহাদীছ আন্দোলনের নেতৃত্বে আল্লামা আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কোরায়শীর প্রবর্তিত আন্দোলনকে তিনি আরও সুসংহত করেছেন।
গোষ্ঠীগত সীমার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি আহলেহাদীছকে একটি বিস্তৃত ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করেছেন।
তাঁর মতে, মানুষের ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি একমাত্র আল্লাহর বিধানের প্রতি নি:শর্ত আত্মসমর্পণে নিহিত।
“সকল বিধান বাতিল কর, অহির বিধান কায়েম কর।” – ড. আসাদুল্লাহ আল গালিব
তিনি বিজাতীয় মতবাদ ও মাযহাবের বিপক্ষে ছিলেন এবং রাষ্ট্র ও সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্র ও জঙ্গীবাদকে
প্রথাগত উপায় হিসেবে না মনে করে মানুষের আক্বীদা-আমলের সংস্কারের মাধ্যমে সার্বিক সংস্কারের আহ্বান জানান।
আরও পড়ুন
কারাবরণ
২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মিথ্যা অভিযোগে তাকে জঙ্গীবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত দেখিয়ে গ্রেফতার করা হয়।
দীর্ঘ তিন বছর সাড়ে তিন মাস কারাবরণ শেষে ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট মুক্তি পান।
পরবর্তীতে সমস্ত মামলা থেকে বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত হন।
ইসলামের প্রতি একনিষ্ঠ এই খাদেমকে মহান আল্লাহ নেক হায়াত ও বরকত দান করুন। আমিন।
📚 মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের বইসমূহ
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের pdf বই ডাউনলোড করতে নিচে বইয়ের নামের উপর ক্লিক করুন।
১। আকীদা ইসলামিয়াহ
২। আশুরায়ে মুহাররম ও আমাদের করণীয়
৩। ইনসানে কামেল
৪। ইসলামী খিলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন
৫। উদাত্ত আহবান
৬। ছবি ও মূর্তি
৭। জিহাদ ও কিতাল
৮। জীবন দর্শন
৯। তালাক ও তাহলীল
১০। তিনটি মতবাদ
১১। দাওয়াত ও জিহাদ
১২। ধর্ম নিরপক্ষ মতবাদ
১৩। নবীদের কাহিনী
১৪। নৈতিক ভিত্তি ও প্রস্তাবনা
১৫। মাসায়েলে কুরবানি ও আকীকা
১৬। মীলাদ প্রসংগ
১৭। শবেবরাত
১৮। সমাজ বিপ্লবের ধারা
১৯। সালাতুর রাসুল
২০। সীরাতুল রাসুল সাঃ
২১। হজ্জ ও উমরাহ
২২। হিংসা ও অহংকার