
অধ্যাপক গোলাম আযম : জীবন, কর্ম ও উত্তরাধিকার
✍️ ভাষা আন্দোলনের কর্মী | জামায়াতে ইসলামীর আমীর | লেখক | চিন্তাবিদ
প্রস্তাবনা
গোলাম আযম (৭ নভেম্বর ১৯২২ – ২৩ অক্টোবর ২০১৪) ছিলেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বহুল আলোচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি একদিকে ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর দীর্ঘকালীন আমীর। তাঁর জীবন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, শিক্ষাজীবন, দাওয়াহ ও লেখনীতে সমৃদ্ধ। যদিও তাঁর ভূমিকা নিয়ে সমাজে ভিন্নমত বিদ্যমান, ইতিহাসে তিনি প্রভাবশালী নেতা ও সংগঠক হিসেবে স্বীকৃত।
“আমি বিশ্বাস করি, ইসলামের মূলনীতির আলোকে রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলাই মানুষের জন্য কল্যাণকর।” – গোলাম আযম
প্রারম্ভিক জীবন
১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন গোলাম আযম। তাঁর পিতা গোলাম কবির ছিলেন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি এবং মাতা সৈয়দা আশরাফুন্নিসা শিক্ষিত ও নৈতিকতাসম্পন্ন নারী। শৈশব থেকেই তিনি ইসলামী শিক্ষায় বেড়ে ওঠেন। গ্রামীণ পরিবেশে শৈশব অতিবাহিত হওয়ায় তাঁর চরিত্রে সরলতা, দৃঢ়তা ও ধর্মীয় অনুরাগ গড়ে ওঠে।
শিক্ষাজীবন
প্রথমে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিরগাঁও গ্রামের একটি মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ঢাকায় এসে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হন এবং ১৯৪৭ সালে বিএ ও ১৯৫০ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছাত্রজীবনেই তিনি অসাধারণ নেতৃত্বের পরিচয় দেন এবং সমসাময়িক ছাত্র রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
“শিক্ষা মানুষকে শুধু আলোকিত করে না, বরং তাকে সমাজ পরিবর্তনের উপযুক্ত হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলে।” – গোলাম আযম
ছাত্র রাজনীতি ও ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় গোলাম আযম ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাধারণ সম্পাদক (জিএস) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে স্মারকলিপি পেশ করেন। এজন্য তিনি গ্রেফতার হন এবং সরকারি চাকরি থেকেও বঞ্চিত হন।
“রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে কোনো আপস করা যায় না। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের আত্মার ভাষা।” – গোলাম আযম
কর্মজীবন
১৯৫০ সালে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি তাবলীগ জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ১৯৫২–১৯৫৪ সাল পর্যন্ত রংপুর অঞ্চলের আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গেও কাজ করেন।
১৯৫৪ সালে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন। ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৯ সালে আমীর নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়েও তিনি একই পদে ছিলেন। স্বাধীনতার পরও তিনি ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রচনাবলী ও বৌদ্ধিক অবদান
অধ্যাপক গোলাম আযম শুধু রাজনীতিবিদই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন লেখক ও চিন্তাবিদও। তাঁর রচনায় ইসলাম, রাজনীতি, নৈতিকতা ও মুসলিম ঐক্যের আহ্বান প্রধানভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
“মুসলমানদের মুক্তি নিহিত রয়েছে আল্লাহর বাণী ও রাসূলের (সা.) সুন্নাহ মেনে চলার ভেতরে।” – গোলাম আযম
চিন্তাধারা
তাঁর চিন্তাধারার মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামী আদর্শের আলোকে রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা। মওদুদীর চিন্তাধারার দ্বারা তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন। পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ ধারা ও রাজনৈতিক দর্শনের সমালোচক হিসেবে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। তাঁর মতে, ইসলামই মানবতার মুক্তির একমাত্র পথ।
প্রভাব ও উত্তরাধিকার
বাংলাদেশের রাজনীতিতে গোলাম আযমের ভূমিকা একইসঙ্গে প্রভাবশালী ও বিতর্কিত। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার কারণে তিনি ইতিবাচকভাবে স্মরণীয় হলেও মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে।
তবুও ইসলামী রাজনীতিতে তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ও নেতৃত্ব পরবর্তী প্রজন্মকে প্রভাবিত করেছে। তাঁর অনুসারীরা তাঁকে জামায়াতে ইসলামীর তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে শ্রদ্ধা করে, আর সমালোচকেরা মুক্তিযুদ্ধকালীন কর্মকাণ্ডের জন্য সমালোচনা করে আসছেন।
“গোলাম আযম ছিলেন একাধারে নেতা, চিন্তাবিদ ও সংগঠক। তাঁকে ঘিরে বিতর্ক থাকলেও ইসলামী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।” – সমকালীন এক গবেষক
মৃত্যু
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পর ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
উপসংহার
গোলাম আযম ছিলেন জটিল ও বহুমাত্রিক রাজনৈতিক চরিত্র। তিনি একদিকে জাতীয় সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন, অন্যদিকে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান বিতর্কিত থেকেছে। তবে তিনি ছিলেন নিরলস রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ। তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে নেতৃত্ব ও রাজনীতি সময় ও পরিস্থিতির আলোকে ভিন্ন ভিন্ন মূল্যায়ন পায়।
আরও পড়ুন
👉 উইকিপিডিয়া: গোলাম আযম
👉 সাইয়েদ কুতুব শহীদ
📚 অধ্যাপক গোলাম আযম এর বইসমূহ
অধ্যাপক গোলাম আযমের pdf বই ডাউনলোড করতে নিচে বইয়ের নামের উপর ক্লিক করুন।
১। অমুসলিম নাগরিক ও জামায়াতে ইসলামী
২। আদম সৃষ্টির হাকিকত
৩। আদর্শ রুকন
৪। আধুনিক পরিবেশে ইসলাম
৫। আযানের মাধ্যেমে কাদেরকে নামাযে ডাকা হয়
৬। আল্লাহ তায়ালার সাথে মানুষের সম্পর্ক
৭। আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন
৮। আল্লাহর খেলাফত প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি
৯। আল্লাহর দুয়ারে ধরণা
১০। আসুন আল্লাহর সৈনিক হই
১১। ইকামাতে দ্বীন
১২। ইসলাম ও গনতন্ত্র
১৩। ইসলাম ও দর্শন
১৪। ইসলাম ও বিজ্ঞান
১৫। ইসলামী আন্দোলনঃ কর্মীদের ৭ দফা
১৬। ইসলামী আন্দোলন সাফল্য ও বিভ্রান্তি
১৭। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের প্রাথমিক পুঁজি
১৮। ইসলামী ঐক্য ইসলামী আন্দোলন
১৯। ইসলামী ঐক্যমঞ্চ চাই
২০। ইসলামী সভ্যতা বনাম পাশ্চাত্ত্য সভ্যতা
২১। ইসলামের পুনরুজ্জীবনে মাওলানা মওদুদীর অবদান
২২। ইসলামের সহজ পরিচয়
২৩। একজন মানুষঃ যিনি দুনিয়া ও আখিরাতে অত্যাবশ্যক
২৪। কর্মীদের ৭দফা
২৫। কিশোর মনে ভাবনা জাগে
২৬। কুরআন বুঝা সহজ
২৭। কুরআনে ঘোষিত মুসলিম শাসকদের ৪ দফা কর্মসূচি
২৮। খাঁটি মুমিন হতে হলে তাগুতের পাক্কা কাফির হতে হবে
২৯। খাঁটি মুমিনের সহীহ জযবা
৩০। চিন্তাধারা
৩১। জাতীয় সংসদে রাজনৈতিক দলের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতি
৩২। জামায়াতে ইসলামীর কর্মনীতি
৩৩। জামায়াতে ইসলামীর বৈশিষ্ট্য
৩৪। জীবন্ত নামাজ
৩৫। তাওহীদ শিরক ও তিন তাসবীহর হাকীকত
৩৬। তাকবীর তাওয়াক্কুল সবর
৩৭। দীন ইসলামের শিক্ষাদানে বুনিয়াদী গলদ
৩৮। দ্বীন ইসলামের ১৫ টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক ধারণা
৩৯। দেশ গড়ার ডাক
৪০। ধর্ম নিরপক্ষ মতবাদ
৪১। নবী জীবনের আদর্শ
৪২। নাফস রূহ কালব
৪৩। পলাশী থেকে বাংলাদেশ
৪৪। পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসেবে ইসলামের সহজ পরিচয়
৪৫। প্রশান্তচিত্ত মুমিনের ভাবনা
৪৬। প্রশ্নোত্তর
৪৭। বাইয়াতের হাকীকত
৪৮। বাংলাদেশ ও জামায়াতে ইসলামী
৪৯। বাংলাদেশী বনাম বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ
৫০। বাংলাদেশে ইসলামী ঐক্য প্রচেষ্টার ইতিহাস
৫১। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটনাবহুল ৭৫ সালঃ আগস্ট ও নভেম্বর বিপ্লব
৫২। বাংলাদেশের জনগণের নিকট ১৫ আগস্ট কি শেখ মুজিব কি জাতির পিতা
৫৩। বিয়ে তালাক ফারায়েয
৫৪। বিশেষ আবেদন
৫৫। মনটাকে কাজ দিন
৫৬। মযবুত ঈমান
৫৭। মযবুত ঈমান সহীহ ইলম নেক আমল
৫৮। মসজিদের ইমামদের মর্যাদা ও দায়িত্ব
৫৯। মাওলানা মওদূদীকে (র) যেমন দেখেছি
৬০। মানবজাতির স্রষ্টা যিনি, বিধানদাতাও একমাত্র তিনি
৬১। মুমিনের জেলখানা
৬২। মুমিনের প্রথম কাজ
৬৩। মুসলিম নেতাদের এ দশা কেন প্রতিকারই বা কি
৬৪। মুসলিম মা বোনদের ভাবনার বিষয়
৬৫। মুহতারাম আলেমসমাজ ও দ্বীনদারদের খেদমতে জরুরী প্রশ্ন
৬৬। যুক্তির কষ্টিপাথরে জন্মনিয়ন্ত্রণ
৬৭। রাজনৈতিক দলের সংস্কার
৬৮। রাষ্ট্রক্ষমতার উত্থান পতনে আল্লাহ তায়ালার ভূমিকা
৬৯। রাসূলগণকে আল্লাহ তায়ালা কি দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন
৭০। রুকনিয়াতের আসল চেতনা
৭১। রুকনিয়াতের দায়িত্ব ও মর্যাদা
৭২। শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামী রূপরেখা
৭৩। শ্রমিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান
৭৪। শেখ হাসিনার দুঃ শাসনের ৫ বছর
৭৫। ষ্টাডী সার্কেল
৭৬। সৎ লোকের এতো অভাব কেন
৭৭। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন







সার্বিক কল্যাণ কামনা করি। ধন্যবাদের ভাষা নেই। খুবই সুন্দর সংগ্রহ। অত্যন্ত উপকৃত হলাম। শুকরিয়া।