শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমীন: জীবন, কর্ম ও অবদান
✍️ বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীন | প্রখ্যাত ফকীহ | শিক্ষক | দাওয়াতি নেতা
প্রস্তাবনা
শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন (১৯২৭ – ২০০১) ছিলেন সমসাময়িক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামি চিন্তাবিদ, মুফাসসির ও ফকীহ।
তিনি কুরআন, হাদীস, ফিকহ ও আকীদার ক্ষেত্রে অগাধ জ্ঞানার্জন করে মুসলিম উম্মাহকে দলীলনির্ভর চিন্তাধারার দিকে আহ্বান করেছেন।
শিক্ষাদান, ফতোয়া, বক্তৃতা ও শতাধিক গ্রন্থের মাধ্যমে তাঁর অবদান ইসলামি বিশ্বে স্থায়ীভাবে স্বীকৃত।
“হক বা সত্য আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়; তা আমাদের প্রিয় শায়খের কথারও ঊর্ধ্বে।” – শায়খ উসাইমীন
প্রারম্ভিক জীবন
১৯২৭ সালে সৌদি আরবের আল-কাছীম প্রদেশের উনায়যাহ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
তাঁর পরিবার ছিল ধার্মিক ও ইসলামি শিক্ষায় সমৃদ্ধ। চতুর্থ ঊর্ধ্বতন পুরুষ উসমান আল-উসাইমীনের নাম থেকেই তাঁর বংশপরিচয় “উসাইমীন” রূপে প্রসিদ্ধি পায়।
শৈশবে নানা আব্দুর রহমান বিন সুলাইমান আলে দামিগ (রহ.)-এর কাছে কুরআন শিক্ষার সূচনা হয় এবং মাত্র ছয় মাসে তিনি পূর্ণ কুরআন হিফজ করেন।
শিক্ষাজীবন
শৈশবেই তিনি হাতের লেখা, অংক ও আরবি সাহিত্যের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন।
প্রথমে শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল আজীয আল-মুতাওয়া (রহ.)-এর কাছে তাওহীদ, ফিকহ ও আরবি ব্যাকরণ শিখেন।
পরবর্তীতে উনায়যার প্রখ্যাত আলেম শায়খ আব্দুর রহমান বিন নাসির আস-সা‘দীর (মৃ. ১৩৭৬ হি.) দরসে দীর্ঘ ১৬ বছর তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, উছূলুল ফিকহ, ফারায়েয ও নাহু প্রভৃতি শাস্ত্রে উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করেন।
এছাড়া শায়খ আব্দুর রহমান বিন আলী আওদান (রহ.) ও শায়খ আব্দুর রাযযাক আফীফী (রহ.)-এর নিকট থেকে বিশেষভাবে ফারায়েয, নাহু ও বালাগাত শিক্ষা গ্রহণ করেন।
উচ্চশিক্ষা
১৩৭২ হিজরীতে তিনি রিয়াদে “আল-মা‘হাদুল ইলমী”-তে ভর্তি হন। এখানে শায়খ মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানকীতী (মৃ. ১৩৯৩ হি.), শায়খ আব্দুল আযীয বিন নাসির রশীদ, আব্দুর রহমান আফ্রিকী প্রমুখ বিশিষ্ট আলেমদের কাছে শিক্ষা লাভ করেন।
বিশেষভাবে সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (রহ.) তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেন।
তিনি রিয়াদের ইমাম মুহাম্মাদ বিন সউদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শরীআহ অনুষদে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন।
“জ্ঞানার্জন হলো এক অবিরাম সাধনা, যা মানুষের জীবনকে আলোকিত করে।” – শায়খ উসাইমীন
কর্মজীবন
শিক্ষাজীবনেই তিনি ১৩৭০ হিজরীতে উনায়যার আল-জামিউল কাবীর মসজিদে শিক্ষকতা শুরু করেন।
১৩৭৪ হিজরী থেকে উনায়যার আল-মা‘হাদুল ইলমীতে শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তীতে ইমাম মুহাম্মাদ বিন সউদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-কাছীম শাখায় শরীআহ অনুষদের অধ্যাপক হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিক্ষকতা অব্যাহত রাখেন।
দাওয়াতি কর্মতৎপরতা
শিক্ষাদানই ছিল তাঁর দাওয়াতি কর্মতৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু। তিনি বিভিন্ন স্থানে ইসলামী দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য প্রদান করতেন।
– হজ মৌসুমে হাজীদের উদ্দেশ্যে খুতবা ও দিকনির্দেশনা দিতেন।
– মসজিদে নববী ও মসজিদে হারামে রমজান ও গ্রীষ্মকালে নিয়মিত দরস দিতেন।
– টেলিফোন ও বেতার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইউরোপ, আমেরিকা সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিতেন।
– “নূরুন আলাদ দারব” শীর্ষক রেডিও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
পরিষদ ও দায়িত্ব
১৪০৭ হিজরী থেকে আমৃত্যু তিনি সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সদস্য ছিলেন।
এছাড়া ইমাম মুহাম্মাদ বিন সউদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিষদ ও আল-কাছীম শাখার শরীআহ অনুষদের পরিষদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
চিন্তাধারা
শায়খ উসাইমীন ফিকহ ও আকীদার ক্ষেত্রে দলীলনির্ভর মতামত প্রদানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি হাম্বলী মাযহাবকে শ্রদ্ধা করলেও অন্ধ অনুসরণ করতেন না।
তিনি বহু ক্ষেত্রে হাম্বলী মাযহাবের বিপরীতে দলীলভিত্তিক ফতোয়া প্রদান করেছেন।
তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্পষ্ট – “ইবনু তায়মিয়া আমাদের প্রিয়, কিন্তু সত্য তার চেয়েও প্রিয়।”
রচনাবলী
শায়খ উসাইমীনের রচিত গ্রন্থ সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- মাজমূউ ফাতাওয়া ও রাসাইল – ৪২ খণ্ড
- আশ-শারহুল মুমতি – হাম্বলী ফিকহের বিশদ ব্যাখ্যা, ১৬ খণ্ড
- আল-কাওলুল মুফীদ আলা কিতাবিত তাওহীদ – ৩ খণ্ড
- শারহু রিয়াযিছ ছালিহীন – ৭ খণ্ড
- শারহুল আকীদা আল-ওয়াসিতিয়্যাহ – ২ খণ্ড
- মাজালিসু শাহরি রামাযান
- আল-মানহাজ লিমুরীদিল উমরা ওয়াল হজ্জ
“আশ-শারহুল মুমতি শুধু হাম্বলী ফিকহ নয়, সমসাময়িক ফিকহি জ্ঞানপিপাসুদের জন্য এক অনন্য রচনা।” – গবেষক মতামত
প্রভাব
শায়খ উসাইমীনের প্রভাব শুধু সৌদি আরবেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং পুরো ইসলামি বিশ্বে বিস্তৃত হয়েছে।
তাঁর গ্রন্থাবলী, ফতোয়া ও বক্তৃতা এখনও মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ পাঠকদের মাঝে সমানভাবে জনপ্রিয়।
তিনি মুসলিম উম্মাহকে দলীলনির্ভর ফিকহি চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং তরুণ প্রজন্মকে সঠিক আকীদা ও আমলের দিকে আহ্বান করেছেন।
মৃত্যু
২০০১ সালের ১০ জানুয়ারি (১৫ শাওয়াল ১৪২১ হি.) বুধবার জেদ্দায় মাগরিবের পূর্বে তিনি ইন্তেকাল করেন।
পরদিন মসজিদে হারামে তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁকে মক্কার আল-আদল কবরস্থানে তাঁর শিক্ষক শায়খ বিন বাযের পাশে সমাহিত করা হয়।
মৃত্যুর পরও তাঁর রচনাবলী ও চিন্তাধারা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন আলোকিত করছে।
“একজন আলেম চলে গেলেও তাঁর কলমের আলো প্রজন্মকে সত্যের পথে পরিচালিত করে।”
উপসংহার
শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী আলেমে দ্বীন।
তিনি দলীলনির্ভর গবেষণা, স্পষ্ট চিন্তাধারা ও অগণিত গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল দিকনির্দেশক।
তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া যায় যে, ইসলামি জ্ঞান শুধু বইয়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা মানুষের জীবনকে পরিবর্তন করার জন্য প্রয়োগ করতে হয়।
তাঁর উত্তরাধিকার মুসলিম সমাজে জ্ঞানের আলো হিসেবে চিরকাল প্রবাহিত হবে।
আরও পড়ুন
👉 আল-উসাইমীন অফিসিয়াল ওয়েবসাইট
👉 ইসলামি বইয়ের তালিকা
📚 মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমীন এর বইসমূহ
মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমীন কর্তৃক রচিত ইসলামিক pdf বই ডাউনলোড করতে নিচে নামের উপর ক্লিক করুন।
১। আলেমগণের মধ্যে মতভেদ কারণ এবং আমাদের অবস্থান
২। আল্লাহ তাআলার নান্দনিক নাম ও গুণসমগ্র কিছু আদর্শিক নীতিমালা
৩। আল্লাহর দিকে দাওয়াতের সম্বল
৪। আহলি সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা বা বিশ্বাস
৫। ইসলাম স্বীকৃত অধিকার
৬। ইসলামী পুনর্জাগরণে পথ ও পদ্ধতি
৭। ইসলামী মূল আকীদাহর বিশ্লেষণ
৮। ইসলামে দায়ীদের প্রতি পয়গাম
৯। ঈমানের মূলনীতি সমূহের ব্যাখ্যা
১০। উমরায় করণীয় কাজসমূহ
১১। উলামার মতানৈক্য আমাদের করণীয়
১২। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে পর্দা
১৩। কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত
১৪। কুরআন-সুন্নাহর আলকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা
১৫। জাকাত
১৬। জাকাতের হকদার
১৭। জানাযার বিধিবিধান সংক্রান্ত ৭০ টি প্রশ্ন
১৮। তওবা
১৯। তাকওয়ার উপকারিতা
২০। নবী সাঃ এর গুণাবলী
২১। নবীর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা ও তার প্রভাব
২২। নামাযের সময়সূচী
২৩। নারীর প্রাকৃতিক রক্তস্রাব
২৪। পর্দাঃ কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে
২৫। প্রকৃতি ও শরীয়ত স্বীকৃত অধিকার
২৬। ফাতোওয়া আরকানুল ইসলাম
২৭। ফাতওয়া আরকানুল ইসলামঃ ঈমান
২৮। ফাতওয়া আরকানুল ইসলামঃ যাকাত
২৯। ফাতওয়া আরকানুল ইসলামঃ সাওম
৩০। ফাতওয়া আরকানুল ইসলামঃ হজ্জ
৩১। মহিলাদের স্রাব ও প্রসূতি অবস্থার বিধিবিধান সংক্রান্ত ৬০ টি প্রশ্ন
৩২। যাকাত সম্পর্কিত ফাতওয়া
৩৩। যাকাতুল ফিতর
৩৪। রমযান মাসের ৩০ আসর
৩৫। শরিয়াতের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও বিদআতের ভয়াবহতা
৩৬। সমাজ সংস্কারে নারীর ভূমিকা
৩৭। সালাত বর্জনকারীর বিধিন
৩৮। সালাতের সময়সূচী
৩৯। সিয়াম তারাবীহ ও যাকাত বিষয়ে কয়েকটি অধ্যায়
৪০। সৌন্দর্য প্রদর্শন বেপর্দা প্রসঙ্গে মুমিনদের জন্য কতিপয় নির্দেশনা
৪১। স্বর্ণ ক্রয় বিক্রয় সংক্রান্ত বিবিধ প্রশ্নোত্তর
৪২। হজ্জ উমরাহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ