
🔊 জুমার খুতবা ও আহকাম — ইসলামী সমাজ সংস্কারের পবিত্র ভাষণ
জুমার খুতবা ইসলামি শরিয়তের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে দ্বীনী শিক্ষা, নৈতিকতা ও সামাজিক সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়। ‘খুতবা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো বক্তৃতা বা ভাষণ। শরিয়তের পরিভাষায় খুতবা হলো— এমন এক ধর্মীয় ভাষণ, যাতে আল্লাহর প্রশংসা, তাওহীদের ঘোষণা, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি দরুদ এবং মুসল্লিদের জন্য উপদেশ ও নসিহত বিদ্যমান থাকে। ‘খুতবাতুল আহকাম’ গ্রন্থটি এই খুতবার নিয়ম-কানুন, সুন্নত ও মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর কুবা মসজিদে প্রথম জুমার নামাজ আদায় করেন, যেখানে তিনি নিজেই ইমামতি করেন এবং দুইটি খুতবা প্রদান করেন। সেই থেকেই প্রতি শুক্রবার নামাজের আগে দুই খুতবা দেওয়ার ঐতিহ্য প্রচলিত হয়, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক সম্মিলিত শিক্ষা মঞ্চ।
জুমার খুতবার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
ইসলামে জুমার নামাজ অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত এবং খুতবা হচ্ছে জুমার নামাজেরই অংশবিশেষ। তাই খুতবা ছাড়া জুমার নামাজ আদায় করা বৈধ নয়। এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং সমাজ সংস্কার ও দিকনির্দেশনার মাধ্যম। জুমার দিন মুসল্লিদের বৃহৎ সমাগম ঘটে—এ সুযোগকে সমাজ সংস্কারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। খুতবার আগে বা মাঝে সমাজে বিদ্যমান অন্যায়, দুর্নীতি, ঘুষ, সুদ, মাদক, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির আহ্বান জানানো অত্যন্ত কার্যকর একটি পদ্ধতি। পাশাপাশি গরিব-মিসকিন, অনাথ ও অভাবগ্রস্তদের সাহায্যে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য। খুতবার মূল বক্তব্য আরবিতে হলেও অনেক সময় ইমাম সাহেবরা সহজভাবে মাতৃভাষায় সংক্ষেপে উপস্থাপন করেন যাতে সাধারণ মানুষ সহজে বিষয়বস্তু বুঝতে পারে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট জুমার দিনসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম দিন হলো জুমার দিন।” — (সহীহ ইবনে খুযাইমাহ)
খুতবার নিয়ম ও মাসআলা-মাসায়েল
ইসলামী ফিকহের দৃষ্টিকোণ থেকে খুতবার কিছু আবশ্যিক নিয়ম (ফরজ, ওয়াজিব) ও সুন্নত রয়েছে। এই নিয়মগুলো সঠিকভাবে পালন করা খুতবার বৈধতার জন্য অপরিহার্য। খুতবা সবসময় দাঁড়িয়ে দিতে হয়, যেমনটি রাসূলুল্লাহ (সা.) করতেন। (মুসলিম: ১/২৮৩)। এছাড়াও, মুসল্লিদের মুখোমুখি হয়ে খুতবা পাঠ করা, আউজুবিল্লাহ ও আল্লাহর প্রশংসা পাঠের মাধ্যমে শুরু করা এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ করা খুতবার অন্যতম সুন্নত। গ্রন্থসমূহে জুমার খুতবাকে সংক্ষিপ্ত রাখার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, কারণ এটি প্রজ্ঞার নিদর্শন। (সহীহ মুসলিম: ১/২৮৬)। আল্লামা কাসানি (রহ.) এবং অন্যান্য ফিকহবিদদের মতে, জুমার খুতবা দুইটি হওয়া সুন্নত এবং মিম্বরে দাঁড়িয়ে প্রদান করাও সুন্নত।
খুতবা শ্রবণের আদব ও নিষিদ্ধ কাজসমূহ
খুতবা চলাকালে মুসল্লিদের জন্য কিছু বিশেষ আদব ও বিধি-নিষেধ রয়েছে, যা কঠোরভাবে পালনীয়। খুতবা চলাকালে নীরবে মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা ওয়াজিব। অপ্রয়োজনে কথা বলা, চলাফেরা করা বা অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— “যখন খুতবা চলমান থাকে, তখন যদি তুমি তোমার সঙ্গীকে বলো ‘চুপ করো’, তবে তুমি অনর্থক কথাই বললে।” (সহীহ বুখারি: ১/১২৮)। অন্য হাদিসে এসেছে— “যখন ইমাম খুতবার জন্য বের হন, তখন নামাজ পড়বে না, কথাও বলবে না।” (মেশকাত: ৩/৪৩২)।
‘ফাতাওয়ায়ে শামী’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে— নামাজে যেসব কাজ হারাম, খুতবা চলাকালীন সময়েও সেগুলো হারাম। যেমন— কথা বলা, পানাহার করা, হাসাহাসি, অযথা চলাফেরা ইত্যাদি। বর্তমানে কিছু মসজিদে খুতবার সময় চাঁদা তোলা বা বাক্স চালানো দেখা যায়, যা শরিয়তের দৃষ্টিতে না-জায়েজ। এসব কাজ থেকে বিরত থেকে মনোযোগসহ খুতবা শ্রবণ করা প্রত্যেক মুসল্লির দায়িত্ব।
হাদীস: “যে ব্যক্তি উত্তমভাবে পবিত্রতা অর্জন করল, তারপর জুমার জন্য এলো, খুতবা মনোযোগ সহকারে শুনল এবং নীরব রইল, তার বিগত জুমার মধ্যবর্তী সব পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।” — (সহীহ মুসলিম)
খুতবার সুন্নত ও ইসলামী ঐতিহ্য
‘ফাতাওয়ায়ে আলমগীরি’তে খুতবার ১৫টি সুন্নত উল্লেখ করা হয়েছে। এই সুন্নতগুলো খুতবার গুরুত্ব ও পবিত্রতা বৃদ্ধি করে। সুন্নতগুলোর মধ্যে প্রধান হলো— অজু ও পবিত্রতার সঙ্গে খুতবা প্রদান করা; দাঁড়িয়ে খুতবা দেওয়া; দুটি খুতবার মাঝে স্বল্প সময়ের জন্য বসা, যেমনটি হজরত জাবের ইবনে সামুরা (রা.) বর্ণনা করেন— “রাসূলুল্লাহ (সা.) দুই খুতবা পাঠ করতেন এবং উভয়ের মাঝে বসতেন।” (সহীহ মুসলিম: ১/২৮৩); ওয়াজ-নসিহত ও কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করা; এবং দ্বিতীয় খুতবায় মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া করা ও প্রার্থনা করা। এই সুন্নতগুলো জুমার খুতবাকে শুধুমাত্র ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং সমাজ সংস্কার, আত্মশুদ্ধি ও জ্ঞানচর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমে পরিণত করে।
লেখক মনে করেন — খুতবার মাধ্যমে সমাজের বিদ্যমান সমস্যা ও তার সমাধান কোরআন-হাদিসের আলোকে উপস্থাপন করা ইমামদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
খুতবার মাধ্যমে শিক্ষণীয় দিক
জুমার খুতবা মুসলিম উম্মাহর জন্য শিক্ষণীয় বিষয়াদির আধার। এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে ইমাম ও খতিবগণ সমাজে দ্বীনি চেতনা ও নৈতিক জাগরণ সৃষ্টি করতে পারেন।
- ইসলামে জুমার নামাজের গুরুত্ব ও খুতবার অপরিহার্যতা সম্পর্কে জানতে।
- খুতবা চলাকালীন কী কী কাজ বৈধ ও কী কী কাজ নিষিদ্ধ, তার শরয়ি নির্দেশনা পেতে।
- খুতবার সুন্নতগুলো পালন করে কিভাবে জুমার ইবাদতকে আরও ফলপ্রসূ করা যায়।
- সমাজকে দুর্নীতি, অন্যায় ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার জন্য খুতবার ভূমিকা উপলব্ধি করতে।
- ইমাম ও খতিবদের জন্য খুতবার মান উন্নত করার ব্যবহারিক পরামর্শ গ্রহণ করতে।
গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা: “খুতবার উদ্দেশ্য কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং তা মুসলিম উম্মাহকে জাগিয়ে তোলার জন্য এক ঐশী বার্তা।”
গ্রন্থের উপযোগিতা ও পাঠকের প্রতি বার্তা
আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) কর্তৃক সংকলিত “খোৎবাতুল আহকাম” গ্রন্থটি জুমার খুতবা বিষয়ে ফিকহী মাসআলা ও ব্যবহারিক দিকনির্দেশনার এক নির্ভরযোগ্য উৎস। এই বইটি সকল ইমাম, খতিব, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী এবং সাধারণ পাঠকের জন্য অত্যন্ত উপযোগী, যারা জুমার খুতবার মূল উদ্দেশ্য, আদব ও ফিকহী দিক সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী। এই গ্রন্থটি পারিবারিক লাইব্রেরির জন্যও এক অপরিহার্য সংযোজন।
আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) রচিত “খোৎবাতুল আহকাম” pdf বই ডাউনলোড করতে নিচে বইয়ের নামের উপর ক্লিক করুন।
আবার ভিজিট করবেন !!! ধন্যবাদ






