✍️ ইসলামের একজন অকুতোভয় দাঈ | চিন্তাবিদ | লেখক | সমাজসেবক
প্রস্তাবনা
মরহুম আবুল হোসেন ভট্টাচার্য (১৯১৬ – ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩) ছিলেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত যিনি হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করে আজীবন ইসলামের দাওয়াত ও মানবকল্যাণে নিবেদিত ছিলেন।
তিনি ছিলেন একাধারে চিন্তাবিদ, সমাজসেবক, লেখক এবং নও-মুসলিমদের পুনর্বাসন আন্দোলনের পথিকৃৎ। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ইসলাম গ্রহণের পর মানবতার সেবায় এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
“যে সত্যের সন্ধান করে, আল্লাহ তাকে নিজেই সেই সত্যের পথে পরিচালিত করেন।” – আবুল হোসেন ভট্টাচার্য
প্রারম্ভিক জীবন
১৯১৬ সালে ফরিদপুর জেলার (বর্তমান শরীয়তপুর) গোসাইরহাট উপজেলার দাসের জঙ্গল গ্রামে এক পুরোহিত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সুদর্শন ভট্টাচার্য।
পিতা ছিলেন শশীকান্ত ভট্টাচার্য এবং মাতা রাঙা বউ। ছোটবেলা থেকেই তিনি ধর্মীয় ও দর্শনচিন্তায় আগ্রহী ছিলেন। গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন।
ইসলাম গ্রহণ
১৯৩৭ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নাম গ্রহণ করেন আবুল হোসেন।
তবে তিনি নিজের পৈতৃক পদবী “ভট্টাচার্য” নামের সঙ্গে যুক্ত রাখেন। তাঁর ভাষায়—
“আমি ‘ভট্টাচার্য’ পদবী রেখেছি বংশীয় অহংকারে নয়, বরং প্রমাণের জন্য যে ইসলাম সব শ্রেণীর মানুষের ধর্ম।”
স্কুলজীবনে এক মুসলিম শিক্ষকের প্রভাব তাঁর চিন্তায় গভীর ছাপ ফেলে। শিক্ষক একদিন বলেছিলেন,
“কর্তা অনেক হলে গোলমাল বাধে; সারা জাহানের কর্তা একজনই।”
এই একটি বাক্যই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শৈশবের সেই বীজই পরবর্তীতে তাঁকে এক আল্লাহর সন্ধানে পরিচালিত করে।
শিক্ষা ও আত্মগঠন
ইসলাম গ্রহণের পর তিনি রংপুরের মহিমাগঞ্জ আলিয়া মাদ্রাসা-য় অধ্যয়ন করেন এবং ইসলামি জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করেন।
পরে তিনি মাওলানা আকরম খাঁ, মাওলানা আহসান উল্লাহ, মাওলানা মনিরুজ্জামান আরওয়ারী প্রমুখ বিশিষ্ট আলেমের সান্নিধ্যে আসেন।
তাঁদের গভীর আলোচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ইসলামী চিন্তাধারায় দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেন এবং জীবনের বাকিটা সময় ইসলামের সেবায় উৎসর্গ করেন।
কর্মজীবন
১৯৪৬ সালে তিনি মালদহ জেলায় সাব-ডিভিশনাল পাবলিসিটি অফিসার হিসেবে সরকারী চাকরিতে যোগ দেন।
দেশ ভাগের পর ১৯৪৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহীতে যোগ দেন এবং পরে বাংলাদেশ কৃষিতথ্য সংস্থায় জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২৮ বছর নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে সরকারি দায়িত্ব পালনের পর ১৯৭৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
ইসলাম প্রচার সমিতি
১৯৬৮ সালে ঢাকায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “ইসলাম প্রচার সমিতি”।
তিনি ছিলেন এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং আজীবন এর দাওয়াহ কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
সংগঠনের চারটি মূল লক্ষ্য ছিল—
- নও-মুসলিমদের পুনর্বাসন
- অমুসলিম সমাজে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া
- খ্রিষ্টান মিশনারিদের ভ্রান্ত প্রচারণার মোকাবিলা
- সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা
আন্তর্জাতিক দাওয়াহ ও স্বীকৃতি
১৯৭৮ সালে তিনি সৌদি আরবের রাবিতা আল-আলম আল-ইসলামি-র আমন্ত্রণে হজ সম্পন্ন করেন।
একই বছরে করাচীতে অনুষ্ঠিত প্রথম এশীয় ইসলামী সম্মেলনে অংশ নেন।
পরবর্তীতে কুয়ালালামপুর ও ইরান সফরের আমন্ত্রণ পেলেও তৎকালীন সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি।
তাঁর অসামান্য দাওয়াহ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে তাঁকে মরণোত্তর ইফা পুরস্কারে ভূষিত করে।
রচনাবলী
আবুল হোসেন ভট্টাচার্য ছিলেন একজন প্রখর বিশ্লেষক লেখক। তিনি প্রায় ২০টি বই রচনা করেন, যেগুলোর অধিকাংশই ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণমূলক।
তাঁর লেখনাশৈলী ছিল সহজ, যুক্তিনির্ভর ও মননশীল।
প্রসিদ্ধ গ্রন্থাবলি
- বিশ্বনবীর বিশ্বসংস্কার
- রোযাতত্ত্ব
- মরুর ফুল
- আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম
- আমি কেন খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলাম না
- একটি সুগভীর চক্রান্ত ও মুসলিম সমাজ
- কারবালার শিক্ষা
- উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে
- নবী দিবস
- ইতিহাস কথা কয়
- আর্তনাদের অন্তরালে
- শেষ নিবেদন
- দীন ধর্ম রিলিজিয়ন
- এপ্রিল-ফুলের বেড়াজালে মুসলমান সমাজ
- কোরবানীর মর্মবাণী
- ঠাকুরমার স্বর্গযাত্রা
- বিড়াল বিভ্রাট
- মূর্তিপূজার গোড়া কথা
“তাঁর প্রতিটি রচনা ছিল বিশ্বাস, যুক্তি ও প্রজ্ঞার অনন্য সংমিশ্রণ।” – সমালোচক মতামত
মৃত্যু
১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার তিনি ইন্তেকাল করেন।
ঢাকার বায়তুল মুকাররমে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বনানী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
তাঁর মৃত্যুতে নও-মুসলিম সমাজ গভীরভাবে শোকাহত হয়— তাঁরা হারান তাঁদের পথপ্রদর্শক ও অভিভাবককে।
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
আবুল হোসেন ভট্টাচার্যের জীবন ছিল ত্যাগ, জ্ঞান ও দাওয়াহর এক অম্লান দলিল।
তাঁর কর্ম ও রচনা আজও নতুন প্রজন্মকে সত্যের পথে আহ্বান জানায়।
ইসলাম প্রচার সমিতি তাঁর হাতে বপন করা সেই বীজ, যা আজও ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশে-বিদেশে।
উপসংহার
মরহুম আবুল হোসেন ভট্টাচার্য ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের সাধক, যিনি ধর্মীয় ও সামাজিক অন্ধকারে আলোর প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন।
তাঁর চিন্তা, কর্ম ও রচনাসমূহ মুসলিম সমাজে চিরকাল প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
“তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর কলম আজও ইসলামের দাওয়াত বয়ে নিয়ে চলেছে।”
আরও পড়ুন
👉 ইসলামিক বই সমাহার
👉 রাবিতা আল-আলম আল-ইসলামি
আবুল হোসেন ভট্টাচার্য কর্তৃক রচিত ইসলামী pdf বই ডাউনলোড করতে নিচে বইয়ের নামের উপর ক্লিক করুন।
১। আমি কেন ইসলাম গ্রহণ করলাম
২। আমি কেন খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করলাম না
৩। আর্তনাদের অন্তরালে
৪। ইতিহাস কথা কয়
৫। দীন ধর্ম রিলিজিয়ন
৬। বিড়াল বিভ্রাট
৭। মূর্তিপূজার গোড়ার কথা