
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী : জীবন, কর্ম ও উত্তরাধিকার
✍️ আলেম | দাঈ ইলাল্লাহ | লেখক | চিন্তাবিদ | রাজনৈতিক কর্মী
প্রস্তাবনা
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ – ১৩ আগস্ট ২০২৩) ছিলেন বাংলাদেশের সমসাময়িক ইসলামী আন্দোলনের এক বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব।
তিনি ধর্মীয় শিক্ষা, কোরআনের তাফসীর ও আন্তর্জাতিক দাওয়াহ কার্যক্রমের মাধ্যমে লাখো মুসলমানের হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করেন।
তাঁর তাফসীর মাহফিল প্রায়ই লাখো মানুষের সমাবেশে রূপ নিত। একই সঙ্গে রাজনীতির মঞ্চেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের অভিযোগ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার কারণে তাঁর নাম বিতর্কিত হয়ে ওঠে।
“আমার জীবন আল্লাহর দাওয়াহর জন্য নিবেদিত। মানুষের অন্তরে কোরআনের আলো পৌঁছে দেওয়াই আমার একমাত্র সাধনা।” – আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী
প্রারম্ভিক জীবন
১৯৪০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর জেলার সাইদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
পিতা মাওলানা ইউসুফ সাঈদী ছিলেন স্বনামধন্য আলেম ও ফুরফুরা শরীফের পীরের খলিফা।
মাতা গুলনাহার বেগম ছিলেন ধর্মপ্রাণ নারী।
শৈশব থেকেই ইসলামী শিক্ষা ও নৈতিকতার চর্চায় বেড়ে ওঠেন তিনি।
“আমার পিতা ছিলেন আমার প্রথম শিক্ষক, আর মাতা আমাকে শিখিয়েছিলেন সততা ও নৈতিকতার গুরুত্ব।” – আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী
শিক্ষাজীবন
প্রথমে স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন।
পরে খুলনা আলিয়া মাদ্রাসা এবং ছারছিনা আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। ১৯৬২ সালে কামিল ডিগ্রি অর্জন করেন।
আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন তিনি।
ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি দর্শন, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্পর্কেও জ্ঞান অর্জন করেন।
“শিক্ষা শুধু জ্ঞান অর্জনের নাম নয়, বরং এটি মানুষের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে গড়ে তোলে।” – আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী
দাঈ ইলাল্লাহ হিসেবে আত্মনিয়োগ
১৯৬৭ সাল থেকে তিনি দাওয়াহর ময়দানে আত্মনিয়োগ করেন।
অর্ধশতাধিক দেশে তিনি ইসলামের বাণী প্রচার করেন। তাঁর তাফসীরের বাচনভঙ্গি ও আবেগ শ্রোতাদের গভীরভাবে প্রভাবিত করত।
দেশীয় তাফসীর মাহফিল
- চট্টগ্রাম প্যারেড গ্রাউন্ড – টানা ২৯ বছর
- খুলনা সার্কিট হাউজ মাঠ – ৩৮ বছর
- সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ – ৩৩ বছর
- রাজশাহী সরকারি মাদ্রাসা মাঠ – ৩৫ বছর
- বগুড়া শহর – ২৫ বছর
- ঢাকা কমলাপুর ও পল্টন ময়দান – ৩৪ বছর
“কোরআনের বাণী মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়াই আমার জীবনের মূল লক্ষ্য।” – আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী
রাজনৈতিক জীবন
১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হন।
পরবর্তীতে দলের নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন।
তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার অভিযোগে তাঁর রাজনৈতিক জীবন বিতর্কিত হয়ে ওঠে।
“রাজনীতি আমার কাছে ক্ষমতার জন্য নয়, বরং ইসলামের নীতি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।” – আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবদান
তিনি সৌদি আরব, ইরান, কুয়েত, আমেরিকা, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে দাওয়াহ কার্যক্রম চালান।
- ১৯৮২ সালে ইরানে ইমাম খোমিনির আমন্ত্রণে সফর
- ১৯৯১ সালে কুয়েত-ইরাক যুদ্ধ মীমাংসা বৈঠকে অংশগ্রহণ
- ১৯৯৩ সালে নিউইয়র্কে “আমেরিকান মুসলিম ডে প্যারেড”-এ গ্র্যান্ড মার্শাল
- ২০০০ সালে দুবাইয়ে ৫০,০০০ মানুষের সামনে তাফসীর
“ইসলাম একটি সার্বজনীন ধর্ম। এর দাওয়াহ কেবল বাংলাদেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য।” – আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী
রচনাবলী ও বৌদ্ধিক অবদান
তিনি প্রায় ৭৫টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন।
প্রসিদ্ধ গ্রন্থাবলি
- আখিরাতের জীবনচিত্র
- দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি
- আমি কেন জামায়াতে ইসলামী করি
- সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনে ইসলাম
- শিশুর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি
- রাসূলুল্লাহর (সা.) মোনাজাত
- কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়
- মানবতার মুক্তি সনদ মহাগ্রন্থ আল-কোরআন
- তাফসীরে সাঈদী (একাধিক খণ্ড)
- সীরাতে সাইয়্যেদুল মুরসালীন
“আমার কলমের প্রতিটি অক্ষর ইসলামের দাওয়াহর বাহন।” – আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী
চিন্তাধারা
তাঁর চিন্তার মূল লক্ষ্য ছিল কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা।
তিনি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সমালোচনা করেন এবং ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি দেন।
প্রভাব ও উত্তরাধিকার
তাফসীর মাহফিলের মাধ্যমে লাখো মানুষকে কোরআনের শিক্ষার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
তাঁর সহজবোধ্য ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামকে আকর্ষণীয় করে তোলে।
যদিও রাজনৈতিক জীবনে তিনি বিতর্কিত ছিলেন, ধর্মীয় প্রভাব অস্বীকারযোগ্য নয়।
“তাঁর কণ্ঠে কোরআনের তাফসীর শুনে মানুষ অশ্রুসিক্ত হয়েছে।” – সমকালীন গবেষক
মৃত্যু
২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার হন।
আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অবস্থায় ২০২৩ সালের ১৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
উপসংহার
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ছিলেন বহুমাত্রিক চরিত্রের অধিকারী।
তিনি আলেম, দাঈ, চিন্তাবিদ ও লেখক হিসেবে অম্লান স্মৃতি রেখে গেছেন।
তাঁর জীবন থেকে বোঝা যায় – সময় ও প্রেক্ষাপট একজন ব্যক্তির ভাবমূর্তিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে পারে।
আরও পড়ুন
👉 ইউসূফ আল কারযাভী
👉 তারিক জামিল
📚 দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এর বইসমূহ
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কর্তৃক রচিত ইসলামি pdf বই ডাউনলোড করতে নিচে নামের উপর ক্লিক করুন।
১। আখিরাতের জীবনচিত্র
২। আমি কেন জামায়াতে ইসলামী করি
৩। আল কুরআনের মানদন্ডে সফলতা ও ব্যর্থতা
৪। আল-কুরআনের দৃষ্টিতে ইবাদাতের সঠিক অর্থ
৫। আল-কুরআনের দৃষ্টিতে মহাকাশ ও বিজ্ঞান
৬। আল্লামা সাঈদী রচনাবলী ১ম খন্ড
৭। আল্লামা সাঈদী রচনাবলী ২য় খন্ড
৮। আল্লামা সাঈদী রচনাবলী ৩য় খণ্ড
৯। আল্লাহ কোথায় আছেন
১০। আল্লাহ মৃতদেহ নিয়ে কি করবেন
১১। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান
১২। ইসলামী সংগঠনে আনুগত্য পরামর্শ ইহতিসাব
১৩। ঈমানের অগ্নিপরিক্ষা
১৪। কাদিয়ানীরা কেন মুসলিম নয়
১৫। কুরআন প্রেমিক দেশবাসীর প্রতি আমার খোলা চিঠি
১৬। খোলা চিঠি
১৭। চরিত্র গঠনে নামাযের অবদান
১৮। জাতীয় সংসদে সাঈদী
১৯। জাতীয় সংসদের ভাষণ ও বিভিন্ন সাক্ষাৎকার
২০। জান্নাত লাভের সহজ আমল
২১। দেখে এলাম অবিশ্বাসীদের করুণ পরিণতি
২২। দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি
২৩। দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ধৈর্যের অপরিহার্যতা
২৪। দ্বীনে হক-এর প্রতি দাওয়াত না দেয়ার পরিণত
২৫। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবী ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা
২৬। নন্দিত জাতি নিন্দিত গন্তব্য
২৭। নারী অধিকারের সনদ
২৮। নিজ পরিবারবর্গের প্রতি আমার অসিয়্যত
২৯। নীল দরিয়ার দেশে
৩০। পবিত্র কোরআনের মু’জিজা
৩১। মহিলা সমাবেশে প্রশ্নের জবাব ১ম খণ্ড
৩২। মহিলা সমাবেশে প্রশ্নের জবাব ২য় খণ্ড
৩৩। মানবতার মুক্তি সনদ মহাগ্রন্থ আল কোরআন
৩৪। রাসূলুল্লাহর সাঃ মোনাজাত
৩৫। শিশুর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি
৩৬। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে ইসলাম
৩৭। সীরাতে সাইয়্যেদুল মুরসালীন
৩৮। হাদীসের আলোকে সমাজ জীবন
৩৯। আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ও জামায়াতে ইসলামির বিরুদ্ধে আহলুল হাদীস আলেমদের বিষেদগারের জবাব
তাফসীর
১। তাফসীরে সাঈদী আমপারা
২। তাফসীরে সাঈদী সুর আল আসর
৩। তাফসীরে সাঈদী সুরা আল ফাতিহা
৪। তাফসীরে সাঈদী সূরা লূকমান
৫। বিষয় ভিত্তিক তাফসীরুল কোরআন ১ম খণ্ড
৬। বিষয় ভিত্তিক তাফসীরুল কোরআন ২য় খণ্ড



